বাক্‌ ১১৯ ।। সৈকত আরেফিন ।।

সারমেয়রা

 চিত্রঋণ – সৌমিত্র সামন্ত 



নিঃসঙ্গতা কি এক নিঃসীম শূন্যতার নাম!

গাঢ় অন্ধকারের, বেদনার গভীরতর অনুভবের বা আনন্দের শীর্ষবিন্দুর নাম কি শূন্যতা! না হলে হাহাকারে ডুবে যেতে যেতে বুকের ভেতর কেন মৌন শীতঋতু নেমে আসে! শীতে কাঁপি। অন্ধকারে ডুবে যাই। অন্ধকার কি হতাশার সমার্থ প্রপঞ্চ! না হলে কেন অন্ধকার কেবলই ডুবে যেতে প্রলুব্ধ করে! ডুবে যাই। তখন নরম জ্যোৎস্না আমাকে ভাসায়। অতলে যেতে যেতে জেগে উঠি আত্রাইয়ের ঘন নিসর্গে। ঘন নিসর্গ তবে মায়ের আদরের অনুভূতি। প্রকৃতির বুকের ভেতর মায়ের আদরে ঘুম পেয়ে যায়।  জোসনায় মাখামাখি নদী আত্রাই। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি।
ধুলোপায়ে ইশকুলে যাই। ধুলো গায়ে মেখে ফিরে আসি। ফিরে স্নানে যাই নদীতে। সাঁতরে চোখ লাল করে ফেলি। লাল চোখ দেখে মা বকে। আসলে বকে না, আঁচলে গা মুছিয়ে বকুনির আশীর্বাদ বর্ষণ করে। সন্ধেবেলা পড়ার টেবিলে একটি পাখির পাখনায় উড়ে যাবার স্বপ্নে বা নিজেই সবার আগে ডেকে ওঠার পাখিটি হতে চেয়ে ছেলেটি অঙ্ক খাতা জুড়ে পাখি-আবহে হয়তো আলোই এঁকে চলি। তবু রাত নেমে আসে। ঘন-অন্ধকার রাতে ঘুমোতে পারি না। বন্ধুরা বুকের অসুখ ভেবে অন্ধকার ঘুপচিঘরে কফসিরাপে গলা ভিজিয়ে ফুঁ ফুঁ করে ঘুমায়। বালক তখনও বসে থাকে নদীপাড়ের দুর্বাদলে। একটুখানি হাওয়া কিংবা এক পশলা মিহিন ধুলো তার গা বুলিয়ে যায়। কাদায় বাস করে গায়ে কাদা না মাখা মাছের মতো বালক অন্ধকারেও বুক-আকাশে সূর্য ধরে রাখে। সে জানে, আলোর আরেক নাম স্বপ্ন।  
কিন্তু বালক স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। নিস্পৃহ দিন কাটে। কেউ আসে না। যে সমুদ্র সবচেয়ে সুন্দর সেখানে যাওয়া হয় না। পাহাড় দেখা হয় না সমতলে জন্মানো বালকের। সমতলে মাঠময় ধানখেতঅবিরল সবুজ। হেমন্তে ধানকাটা শূন্য মাঠে নাড়ার হাহাকার পড়ে থাকে। নাড়ার মাঠে হোঁচট খেতে খেতে বালক অসীম আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয়। ঘুড়ি ওড়ানোর দিন গত হতে হতে ছিটকে পড়ে। ছিটকে গিয়ে ছড়িয়ে যায়। নাটাই হারিয়ে ছেলেটি তখন বিগত বাল্যজীবন ছেড়ে তারুণ্যের পতাকা হাতে নগরের রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। 
মফঃস্বলের ছেলেটি তখন উদ্দাম সময়ে, শিহরিত কবিজীবনের স্বপ্নের ভেতর ঢুকে যায়। নতুন শিহরণের স্পর্শে তরুণ ছেলেটি কবিতার প্রেমে পড়ে। রাজধানী নগরের কলেজে, বন্ধুদের আড্ডায় কবিতা ছাড়া আর কিছু নেই।  কলেজ হোস্টেলে কবিতা নিয়ে মগ্ন তর্ক করি। ডাইনিং টেবিলে, টিভি রুমে, পেপারস্ রুমে  হা হা শব্দ করে কবিতা আওড়াই। অনেকে বিরক্ত হয়, কেউ কেউ ‘একেবারে গেছে’ বলে ঠাট্টা করে। সমস্ত উপেক্ষার জ্বর গায়ে নিয়ে নগরের রাস্তায় ভ্রাম্যমান পথিক হয়ে ঘুরি। পাজল বক্সের মতো সারি সারি দালান। দালানের ফাঁকে ফাঁকে আকাশঢাকা বিলবোর্ড। আকাশ দেখা হয় না। ব্যস্ত শহরে আপন মনে বেড়াই। নিঃসঙ্গ ব্যর্থ কবি। একটাও কবিতা হল না হে! এই অনুভব বেদনার মত বুকের ভেতর ঢুকে গেলে রুমে ফিরে কবিতার খাতা পুড়িয়ে ফেলি। কী হবে এইসব অহেতু কাগজের বোঝা বয়ে! কলেজ হোস্টেলের ছাদ থেকে সেই ছাই উড়িয়ে দিই পশ্চিম রাজাবাজারের আকাশে। পোড়া কবিতার কালো ছাই অবাধ আকাশে অল্পই প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। বাতাসে মিশে, একটুখানি উড়ে আরও ওড়ার ব্যর্থতা নিয়ে সেই ছাই রাস্তা পতিত হয়। জনবহুল রাস্তায়, খুব ধীরে জড়োসড়ো হয়ে একা হাঁটি। শহরে, টেলিফোনের তারে কত কাক বসে থাকে! বিষণ্ণ কালো রঙের কাকগুলো গুনিএকটা, দুটো, তিনটে...। যেন এটি একটি সুপারস্টিশন, শেষ করতে না পারলে আমি আর ঘুরে দাঁড়াতেই পারব না।  


তাহলে আবার অন্ধকার ফিরে আসে

চারপাশ ঢেকে দেয় তীব্র অন্ধকার। ছেলেটি তখন আলো জ্বালিয়ে ঘুমোতে যায়। আলো সহজে ঘুমোতে দেয় না। শুয়ে, নিরুদ্বিগ্ন ঘুমের বিপরীতে দেয়াল ঘেঁষে হেঁটে বেড়ানো টিকটিকির কসরত দেখি। শাদা রঙের ফ্যানটি অনবরত ঘুরেই চলে, নিঃশব্দে। ফ্যানের একটানা বাতাস সহ্য লাগে। খুকখুক কাশি হয়। কাশতে কাশতে তরুণ ছেলেটি একটি পুরনো ফিনিক্স সাইকেলের কথা মনে করতে পারে। একটি কাশি দিয়ে আরেকটি কাশির জন্য অপেক্ষা করতে করতে একবার নদীর ওপর ভেঙে পড়া প্রাচীন ব্রিজের কথা মনে হয়। সাইকেলের ঘণ্টা বাজিয়ে নদীপাড়ে গিয়ে বসে থাকা প্রশান্ত বিকেলের সুখস্মৃতি হাহাকার হয়ে পুনরাগমন করে। তখন বুকের মধ্যে জল চ্ছলচ্ছল। বৃদ্ধ আমগাছটির ডাল থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়া দুপুর আর হারিয়ে ফেলা আরও এক লাখ মুহূর্ত হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ে মাথার মধ্যে।
ফ্যানটা বন্ধ করে জানালার পর্দা ফাঁক করে কাচ সরিয়ে দিই। নরোম প্রাকৃতিক বাতাসে ঘরের গুমোট ভাবটা কেটে যায়। ফলে আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। এবার ঘুম হবে। কিন্তু কোথায় ঘুম! ঘুম আসে না। কেবল একটি ঘোরের আবেশ তৈরি হয়। তন্দ্রার মত নিদ্রা আর জাগরণের সেই আবেশের মধ্যে একটা শাদা শার্ট আর জিন্স ইংলিশ প্যান্ট পরে বাবার সাইকেলের ব্যাক-ক্যারিয়ারে চেপে স্কুলে যাই। হঠাৎ কোত্থেকে কার্তিক স্যার উঁকিঝুঁকি মারেন। একটা মোটা বেত লাঠির মত ঘোরে তাঁর হাতের দক্ষতায়। ছ-ফুটের মত লম্বা লোকটিকে দেখে তখন আমরা ভয়ে জড়োসড়ো। এদিক-ওদিক থেকে দৌড়ে শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসি স্কুলঘরের ৩ নম্বর রুমে। আর সবাই সুর করে অ-তে অজগর, অজগরটি আসছে তেড়ে; আ-তে আম, আমটি আমি খাব পেড়ে পড়ে চলি। আমাদের বহু পুরনো স্কুল-দালানটি সেই সুরে, শব্দে গমগম করে কাঁপে। একটু পরে আরও শব্দ করে ঢিং ঢিং বেল বাজে। স্কুল ছুটি হয়ে যায়। স্কুল ছুটি হলে বাবা আসেন নিতে। বাবা কাজের চাপে কখনো আটকে গেলে কার্তিক স্যার আমাকে এমন অনায়াসে সাইকেলের ব্যাকসিটে বসিয়ে দেন যেন একটা কবুতরের বাচ্চাকে আলগোছে তুলে আনেন। আমাদের বাড়ি ছায়াবীথির বার-উঠোনে পৌঁছতে খুব সময় লাগে না। এক-দুবার সাইকেলের ঘণ্টা বাজিয়ে শ্রী কার্তিকচন্দ্র মোদক রানু, রানু বলে অনুচ্চস্বরে ডাকেন। রানু সাড়া দেয় না। এবার আরও একটু উচ্চস্বরে আবারও ডাকেন। রানু আসে না। রানু আমার বড় বোন। কোন কিশোরীকালে মারা গেছে সে! যে নেই সে কীভাবে সাড়া দেবে! কোত্থেকে আসবে! কার্তিক স্যারও জানেন সেটা। তবু কী কারণে, হয়তো অভ্যাসবসে স্যার এবং অন্যরা মাকে ডাকতে অকালে হারিয়ে যাওয়া সেই রানুকেই ডাকেতখন একটু দেরিতে দরজা খুলে মা বেরিয়ে আসেন। রানুর নাম শুনে হয়তো তার বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে। হয়তো এজন্য মেয়ের জন্য তার অসহ বেদনা হয়। কাঁদেন। কান্না সামলে দরজা খুলতে তাই তার দেরি হয়। মা এসে দাঁড়ালে সাইকেল থেকে এক লাফে আমি আমার মায়ের থরথর বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি।



অনেকদিন পরে অন্য শহরে

ভাড়াফ্ল্যাটের পঞ্চম তলার উচ্চতায় ইনসমনিয়া রাতে ছেলেটি তার বোন রানুর জন্যে কাঁদে। রানুর জন্যে, মায়ের জন্যে যুবকের চোখে জল আসে। অকালে চলে যাওয়া বড় মেয়ের জন্যে বেদনার ভারে ডুবে যাওয়া মা, অভিপ্রেত অগণ্য আনন্দ বিসর্জন দেওয়া মা হয়তো শেষপযন্ত ক্যাথারসিসে পৌঁছে যান। কিন্তু একদিনও মাকে না দেখে থাকতে না পারা ছেলেটি লেভেল ফাইভের ফ্ল্যাটে শুয়ে নির্ঘুম রাতের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে। দরজা খুলে মা বেরিয়ে এলে কার্তিক স্যার বলেনখুব লক্ষ্মী ছেলে আপনার। দেখবেন একদিন অনেক বড় হবে ও। স্যারের কথা শুনে সম্প্রতি কান্নার বেগ সামলে আসা মা তখন হাসেন শব্দ করেবড় না ছাই হবে। খুব জ্বালায় আমাকে। কিচ্ছু খেতে চায় না। দেখেন না কেমন কাঠির মতন হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। মা ছেলেকে কোলে নিয়ে চুমু খায়আমার দুষ্টু ছেলেটা!
এভাবে ঘুমহীন তন্দ্রাচ্ছন্ন একটা রাত ক্রমে ভোরের কাছে পৌঁছে যায়। যখন বারান্দায় এসে দাঁড়াই, চারদিক ফর্সা হতে শুরু করে। দূরেরেডিও কলোনির মাঠের ওপারে যোজক প্রজেক্টের বিশাল আবাসিক বিল্ডিং স্পষ্ট দেখা যায়। তখন বিষাদ তীব্র হয়ে আসে। বিষাদ কেন হয়, যুবক কি বোঝে! বুকের মধ্যে কেমন একটা হাহাকার লাগে। যুবকের মনে কিছু একটা হারিয়ে ফেলার অনুভূতি হয়। হারিয়ে ফেলে না খোঁজার অনুতাপে কোথাও একটা চিনচিন ব্যথা করে। হয়তো অনুতাপ বা অস্বস্তি নয়কেবল একটা শূন্যতাবোধ বুকের মধ্যে ব্যাকুল হয়ে বাজে। একটু পরেই রাস্তায় মানুষ বেরুবে। বিদিশাদের বাসার কুকুরগুলো তারস্বরে ডেকে ওঠে। কুকুর ডাকতে শুরু করলে থামে না। একটা ডাকলে আশপাশেরগুলোও ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। বারান্দায় ক্যাকটাস, কয়েকটা বনসাই, আরও কী সব ফুলগাছসবগুলোর নামও জানে না ছেলেটি। বাথরুমের ট্যাপ থেকে পানি এনে অচেনা ফুলের টবে দিতে দিতে সময় কাটে। শমসের মোল্লা রোডে মানুষজনের আনাগোনা শুরু হয়। সূর্য লাল হয়ে উঠতে উঠতে ছেলেটির চোখে ঘুম নামে। ঘুমিয়ে স্বপ্নও দেখে। যেন তারা একটা রাজবাড়িতে বেড়াতে গেছে। তারা দুজন। বিশাল রাজবাড়ির চারদিকে দিঘি। দিঘিতে জল টলমল করে। বড় বড় প্রাচীনকালের কারুকার্য করা দালান। সিঁড়িগুলো অন্ধকার। সিঁড়ি বেয়ে তারা দুজন ওপরে উঠে যায়। ছাদে উঠলে চারপাশটা পরিষ্কার চোখে পড়ে। একটা আয়তাকার রেখার মত চারদিকে বেষ্টনি দেয়া দিঘি। আচমকা  ঝুমঝুম করে বৃষ্টি আসে। ফোটা ফোটা বৃষ্টির মধ্যে ছাদে দাঁড়িয়ে দুটি যুবক-যুবতী ভেজে। স্বপ্নের ঘোরে ভিজতে ভিজতে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙলে ছেলেটি আবার একা। প্রাচীন রাজবাড়িটি কোথায় উবে গেছে। দিঘি নেই, সে নেই, বৃষ্টি নেই। কেবল প্রচণ্ড গরমে ভিজে যাওয়া আছে।
লোডশেডিংয়ে ঘামজলের স্নান করে ছেলেটি একটি নতুন দিনের ব্যস্ততায় ঢুকে যায়।

যুবকের স্মৃতিতে একটি বৃষ্টিস্নানের দিন উজ্জ্বল হয়ে আছে। ক্যাম্পাসজীবনে, হঠাৎ-আসা সেই মেঘলামেদুর দিনটিতে যুবক বৃষ্টি বিষয়ে হারিয়ে ফেলা মনোযোগ ফিরে পায়। কিন্তু সে মনে করতে পারে না, সেদিন র্ষাকাল  ছিল কি নাহয়তো কোনো এক ছুটির দিনে, দুপুরে, তখন বর্ষাকাল, গ্রীষ্ম কিংবা শরৎকাল যাই হোক, সেদিন আকাশভরে একটি রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের বিস্তার হয়। কিন্তু ছুটির দিনে ক্লাস না থাকায় যথাসময়ে ঘুম ভাঙে না। শুয়ে শুয়ে, আলসেমিতে সকালের নাশতার সময় পেরিয়ে যায়। নাশতা করে সিগারেট ধরাবার অভ্যাস তার। যেহেতু নাশতা হয় না, ফলে সকালেই দুটো গোল্ডলিফ পুড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা পায়। তবু কী কারণে তার মনখারাপ লাগে। মনখারাপের দিন নাকি আজ! সকাল-উত্তীর্ণ সেই দুপুরে সদ্য বিছানা ছেড়ে ছেলেটি তাই ভাবে আজ তবে ক্রিকেট খেলা যাক। মন উদাস বা খারাপ হলে তার ক্রিকেট খেলতে ইচ্ছে করে। সুকান্তদের মেসের মাঠে এই খেলাটা তারা প্রায়ই খেলে থাকে। মেসে এক দাদা আছেন, নরেনদা। বল কুড়িয়ে দিতে ভালবাসেন। কখনো ছক্কা হলে বল পাশের বাড়ির দেয়ালের ওপারে চলে যায়। নরেনদা দেয়াল টপকে বল এনে দেন। আমরা নরেনদাকে বলিদাদা খেলেন আমাদের সাথে, এই খেলাটায় কিন্তু মজা আছে। দেখবেন খুব ভাল লাগবে আপনার। শরীরটাও ফ্রেশ থাকবে। দাদা আমাদের কথা শুনে হাসেন। তার হাসিটা সুন্দর। হয়তো যেকোনো কারণেই মানুষ যখন হাসে, কুৎসিত সবকিছু দূরে সরে যায়।  
সুকান্তদের মেসে যেতে শর্টকাট পথ খুঁজে পেতে একটা ভুল গলিতে ঢুকে যাই। এই গলিটা নতুন, আগে কখনো যাই নি এ পথে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে আসি। কিন্তু কোথায় বেরোবার পথ? আমার মনে হয় একটি গোলোকধাঁধায় ঢুকে গেছি, এখান থেকে বেরিয়ে সুকান্তর মেস আর কোনদিন খুঁজে পাব না। তবু ভয় লাগে না বরং নতুন জায়গায় বেড়ানোর আনন্দে শিহরিত হই। এ এলাকাটা ছবির মত। কেমন শান্ত নির্জনতা! আর কেমন নৈঃশব্দ ছড়িয়ে আছে একতলা-দোতলা বাড়িগুলোর দেয়ালে, বারান্দার ফুলের টবে, ছাদে! বাড়িগুলো অন্যরকম, বাড়িগুলোর রেলিং, রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা, মহিলার কোলের শিশু, চশমা পরা ভদ্রলোক, বালিকা, যুবতী সবাই আলাদা। এদের গায়ে কোন রোদ লাগে না কিএরা এত ফর্সা হয় কী করে! লাল টুকটুকে, যেন টোকা দিলে রক্ত বেরোবেএদের কাপড়ে কোন দাগ নেই, এদের কাছে গেলে নিশ্চয়ই বিদেশি পারফ্যুমের গন্ধ পাওয়া যাবে।
হাঁটতে হাঁটতে গলির শেষমাথায় সবচেয়ে উঁচু লাল বাড়িটির কাছে এসে ছেলেটি থমকে দাঁড়ায়। বাড়িটির কারুশোভা তাকে মুগ্ধ করে। তখন, যা কখনো চিন্তাও করে নি, অসম্ভব হলেও সে এরকম একটা বাড়ির স্বত্ত্ব কখনো পেতে চায়। কিন্তু এই ভাবনাও বাধাগ্রস্ত হয় যখন লাল বাড়িটির কলাপসিবল গেইটের ভেতর থেকে কয়েকটা ধুমসো কুকুর আমাকে একযোগে তাড়া করে। এমন কুকুর-অভ্যর্থনার আকস্মিকতায় আমি প্রথমত বিস্মিত হবার সময়ও পাই না। হতবিহ্বল হয়ে, প্রাণভয়ে, স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার একশো মিটারে প্রথম হবার মত দৌড়ে রাস্তার পাশের দিঘিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তখন বর্ষাকাল, গ্রীষ্মকাল না শরৎকালঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নেমে আসে। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে হঠাৎ-আসা সেই বৃষ্টিপতনের শব্দ গানের মত বাজে। দিঘির মধ্যে বৃষ্টি আমাকে আনন্দ দেয়। আনন্দময় নিমগ্ন শিহরণ উদযাপন করি। এভাবে যৌথজলে ভিজে যখন বন্ধু সুকান্তর ‘ভাই ভাই’ মেসে গিয়ে হাজির হই একটা গামছা এগিয়ে দিয়ে সুকান্ত বলেদোস্ত বৃষ্টিতে এক্কেরে ভিইজা গেছ! নাও গা-মাথা ভাল কইরা মুইছা নাও। সেদিন, সেই দুপুরে, কুকুরের তাড়া খেয়ে দিঘিজলে নেমে হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে স্নান করে বৃষ্টি বিষয়ে আমার হারিয়ে ফেলা মনোযোগ ফিরে আসে। গামছা দিয়ে গা মুছতে মুছতে সুকান্তকে বলিভিজবি নাকি বৃষ্টিতে? চল ভিজি।
ভাই ভাই’ মেসের ছাদে বৃষ্টিধারায় মেতে উঠে দুজন অনতিতরুণ গলাছেড়ে গান গায়। গাইতে গাইতে দু-বন্ধু ভেজে আর তাদের ‘ভালই তো গাই’ জাতীয় অনুভূতি হয়; তখন তারা দাড়িঅলা ঠাকুরমশায়ের বৃষ্টি নিয়ে মাতামাতির কারণ বুঝতে পারে। এই অনুভূতি অন্যরকম, উদযাপনেই কেবল তা ধরা দেয়। সেই বৃষ্টিদিনে স্নান শেষে অনেক বিষয়ে মতানৈক্য সত্ত্বেও আমরা দুজনই স্বীকার করে নিই, বুড়োটা একটা জিনিস বটে।


এভাবে, তরুণ ছেলেটি বৃষ্টির প্রেমে পড়ে

বৃষ্টি তাকে ভেজায়, ভিজতে ভিজতে নিমজ্জিত হয়। দক্ষিণের জানালাটা খোলাই রাখে। কখন আকাশে মেঘ জমে দমকা হাওয়ায় ধুলোয় চারদিক ভরে যাওয়ার অপেক্ষা করে। সব মেঘে বৃষ্টি হয় না, সে জানে। সে জানে, নদীজলে স্নান হয়, পান হয় না। তবু সে অপেক্ষা করে বৃষ্টির, ঝড়ের। ঝড় কদাচিৎ আসে। কিন্তু বৃষ্টি তাকে প্রায়ই ভেজায়। বৃষ্টির সঙ্গে সুদূরের সঙ্গী হয়ে ভিজে যাওয়া ছেলেটি হাওয়ায় ভেসে যায়। ঠাকুরমশায় ধীরে, প্রেম, বেদনা, আনন্দ, বিরহ ও বিষণ্নতার অনুভূতি শব্দে অনুবাদ করে দিলে যুবক প্রেমে পড়ে। নারীর। প্রকৃতির।  ইসমত আরা ইতি, প্রজাপতির মতোন মেয়েটি তার জীবনে আসে নিশীথ রাতের বাদলধারা হয়ে। তখন রাতদিন ঘুমহীনতবু স্বপ্ন দেখে। আনন্দে ভাসে, কেঁদে মুখর হয়; তার গোপন বেদনাই হয়তো ইতিকে বলেআমার চোখের জলের দিও সাড়া। কিন্তু ইতি তাকে আঙুলের ওপরে নাচায়। নাচাতে গেলে নাচতে হয়তাই তারা যূথবদ্ধ নাচে, ওড়ে। উড়তে উড়তে হাওয়া ও রোদরঙ মেখে একেকটি দিন ফুরফুর করে পার হয়ে যায়!
তারপর একদিন ঝড় আসে। যুবকের জানা ছিল বৃষ্টি কখনো অবিকল্প নয়বৃষ্টির সঙ্গে কখনো কখনো ঝড়ও আসে। বজ্রপাত হয়। ঋতুবৈচিত্র্যের দেশে বর্ষাকালে বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হয়, গ্রীষ্মকালে দমকা হাওয়াসহ ঝড় আসে। ঝড় সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। যুবক-যুবতীও ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই বিচ্ছিন্নতা হয়তো প্রয়োজনীয় ছিল। বিচ্ছিন্ন সময়ে আমরা একটা অপ্রিয় সত্য অনুধাবন করিপৃথিবীতে কেউ অনিবার্য নয়, কেউ কারও জন্য মরেও যায় না। কিন্তু তখনও প্রাকৃতিক নিয়মেই বর্ষাকালে, গ্রীষ্ম বা শরৎকালেও কিছু বৃষ্টি হয়। তবে সব বৃষ্টি আর ভেজায় না
যুবকটি দক্ষিণের জানালাটি পেরেক মেরে বন্ধ করে দেয়।

বৃষ্টি-নিরপেক্ষ দিনে, পরবর্তী জীবনে হয়তো কোথাও উদয়াস্ত পরিশ্রমের অবসরে কখনো কয়েকটি ধুমসো কুকুর তেড়ে আসে। শমসের মোল্লা গলির শেষমাথায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল যে লাল বাড়িটি; সেই বাড়ির লোহার কলাপসিবল গেইট পেরিয়ে কয়েকটি কুকুর বেরিয়ে এসে ছেলেটিকে তাড়া করে, ছেলেটি দৌড়ে মোল্লার দিঘিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরে সেদিন সে ‘ভাই ভাই’ মেসে গিয়ে কুকুর-তাড়ানির কথাটা সুকান্তের কাছে বেমালুম চেপে যায়। কিন্তু রাগী কুকুরের কয়েকজোড়া চোখ বারবার ফিরে আসে। সেই বিভৎস, উন্মত্ত চোখের নৃশংসতা আমি মুছে দিতে পারি নাইতির চিবুকের কালো তিলে চুমু খাওয়ার মতো দৃশ্যটিও চিরকালীন স্মৃতি হয়ে যায়।
কুকুর কোন কারণ ছাড়াই বেরিয়ে আসেকোন চ্যালেঞ্জ ব্যতিরেকে তাড়া করে। প্রভুভক্তির কিংবদন্তী জানা সত্ত্বেও যুবক কুকুরে আস্থা হারিয়ে ফেলে বৃষ্টির প্রেমে পড়ে। অথচ বিদিশাদের বাড়িতে, গলিতে, বাজারে, রাস্তায় অসংখ্য কুকুর। প্রকাশ্য দিবালোকে নির্লজ্জ যৌনসঙ্গমরত কুকুর-কুকুরির নির্লজ্জপনা, কুকুরীর প্রসববেদনার আরতিতে আমাদের পবিত্র গানগুলো হারিয়ে যায়।  
আমার বুকের মধ্যেও কখনো একটা কুকুর ঘেউ করে ওঠে। ভয়ে দৌড়ে পালাতে যাই। নিজের কাছ থেকে কোথায় পালাব, জীবন! গতানুজীবননিয়ম করে বাইরে বেরোনোমানুষের গায়ের গন্ধ গায়ে মেখে অফিসগামী বাসের সিটে বসে নিজের কুকুরটার সঙ্গে খেলা করিসে কখনো গায়ে চড়ে বসে। কখনো ঘেউ করে ডাকে। বিভৎস, উন্মত্ত নিজের কুকুরটি কেবলই আমাকে হারিয়ে দিতে চায়। ক্লিশে লাগে, ক্লান্ত লাগে। আনন্দ-উদযাপন শেষ না হতেই ঔদাসীন্যর এই ফিরে আসা বিরক্তিকর। একটা পর্ব শেষ হতেআরেকটা এসে আগেরটাকে ভুলিয়ে দেয়। জীবন কি একটা লোকাল বাসের মতো? এক স্টপে একজন যাত্রী নেমে যায়। অন্য স্টপে গিয়ে সেই সিটে অন্য যাত্রী এসে বসে।
সিগারেটের নেশা লাগে। আগুন চাইলে চা-দোকানি ড্রয়ার থেকে দেশলাই বাক্সটি এগিয়ে দেয়। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যুবকটি অনেকদূর চলে যায়। কোথায় যায়? যাবার এত জায়গা কোথায়? বেনসন এন্ড হেজেস পুড়ে ফুরিয়ে যাবার আগে একটা টান দেওয়া দরকার। নিঃশেষিত সিগারেটের ছাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছেলেটি ভাবেআমাকে পোড়াতে পারে এমন আগুন নেই।
অথচ ঠিক জানতাম, আমি এরকম নই স্কুলে প্রতিদিন ক্লাস শুরুর আগে অ্যাসেম্বলিতে লালসবুজ পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গাইতে গাইতে কান্নায় ভেঙে পড়া সেই ছেলেটিই কি আমি? ইসমত আরা ইতি যেদিন চোখের সামনে দিয়ে সিঁড়ির ধাপে ধাপে পা ফেলে অচেনা এক পরীর মত বিবাহ-বাসরে যায় সেদিনও বুকের মধ্যে চ্ছলচ্ছল শব্দ করে বৃষ্টি পড়ে। আর একটা ছোট ময়না পাখি হু হু করে কাঁদে। কুকুরগুলো তখন কোথায় কে জানে! ঘেউ ঘেউও থাকে না। ময়না পাখির কান্না স্পষ্ট শুনতে পারি। বুকের মধ্যে পোষা ময়না পাখিটির জন্য অকাতরে কাঁদি। কিন্তু সেদিন দুপুরবেলার বৃষ্টি আমাকে রক্ষা করে। বৃষ্টি পরম মমতায় ধুয়ে দেয় বিচ্ছেদকাতর, ব্যর্থ যুবকের চোখের জল। ইতিদের ছাদ থেকে ছাদ থেকে মহানন্দা নদী দেখা যায়। শুকিয়ে যাওয়া নদী। নদীর বুকে বড় বড় চর। চরে কাশবন। কাশবন বৃষ্টিতে ভেজে। যুবক যৌথজলে ভিজে যায়অথচ ভেজা আর্দ্র যুবকটিকে এখন আগুন পোড়াতে পারে না। যে কোন বৃষ্টি তাকে ভেজাতে ব্যর্থ হয়। অনুভূতিহীন পাথর না কি আমি! যে মানুষ পাথর হয়ে যায় তার কোন স্বপ্ন থাকে না। স্বপ্নহীন মানুষ বুকে কুকুর নিয়ে ঘোরে। আমার নিজের কুকুরটার সঙ্গে বারবার হেরে যাই। কুকুরের তাড়া খেয়ে জলে ঝাপিয়ে পড়ার একটা স্বচ্ছ জলের দীঘি দরকারনিদেনপক্ষে পুকুর। দিঘিতে বা পুকুরে কুকুর নামতে পারে না। ইতর প্রাণীরা জল ভয় পায়। 


কোথায় আলো কোথায় আলো

নিষ্পত্র বৃক্ষকে কাঁপিয়ে দিয়ে ঝড় আসেটিম টিম জ্বলতে থাকা আলো নিভে যায়। অনাবশ্যক অন্ধকারে আমাদের চোখ কিছু দেখতে পায় না। তখন ধূমল বৃষ্টির অপেক্ষা করি। বৃষ্টি এলে দিঘিতে, পুকুরে জল জমা হবেনদী-নালা প্রাণের উৎসবে কলকল করে বইবেকুকুর তাড়া করলে অনায়াসে ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে। অপেক্ষার নাম কি স্বপ্ন? দিঘি জুড়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে, যুবক তাহলে স্বপ্নই দেখেমানুষের শরীর থেকে একে একে ধুয়ে যাচ্ছে সমস্ত ময়লা, ক্লেদ, সারমেয়রা দূরে সরে যাচ্ছে, চোখ থেকে উবে যাচ্ছে অহেতু ভয়; কাকতালীয়ভাবে, তখন বর্ষাকাল না হলেও ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নেমে আসবে।




No comments:

Post a Comment