।। বাক্‌ ১১৯ ।। বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় ।।






চতুর্থ পর্ব

নদীর গর্ভ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা
এই গ্রাম রক্তমুখী নীলা
অনেক দুঃখের ভার বুকে নিয়ে জন্ম যন্ত্রনায়
অনেক রক্তপাতে রাঙা হয়ে গেছে
আমি তাকে ডেকে যাই ‘ রঙিলা’......  ‘রঙিলা’ ...... 
........................
ভূবনডাঙার মতো মোহনীয়  ঢেউ তোলা দীঘল জ্যোৎস্নায়
আমি তাকে অনায়াসে বলতে পারি রণরক্ত আন্দোলিত লাল ভিয়েতনাম । 


শিয়ালডাঙা জেলার মানচিত্রেও একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম ধু ধু ধূসর এই প্রান্তদেশ ছুঁয়ে একদিকে বয়ে চলেছে ডাংরা নদীতুমুল গরমে যেখানে নদী চুয়ালেও জল মেলে না তপ্ত বালি উগরে দেয় হাহাকার সেই জনপদ জুড়ে মানুষের লড়াইয়ের দাবিগুলি দানা বেঁধেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় ছোট এই গ্রামটিই হয়ে উঠেছে এই অঞ্চলের বিভিন্ন আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতবু সেই পঞ্চাশের দশকে এখানে কবিতাচর্চা নিয়ে তেমন কোন উন্মাদনা ছিল না  
একে অজ পাড়া গাঁ।তার উপর কেউ কখনও কবিতা লেখেনি।সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে শত হাত দূরে এই এলাকার অবস্থান সেখানে খেলাধুলা আছে,মাচা বা ধারিতে বসে আড্ডা আছে।তাস খেলে বা পরচর্চা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিলেও কেউ টু শব্দটি করবে না।কিন্তু কবিতা লিখলেই মুশকিলভিন গ্রহের জীবের মতন অদ্ভুতএক জীব যেনআরও দশজনের থেকে আলাদা। সেরকম গাঁয়ে বসে কবিতা লিখলে যা হয়।বন্ধু বান্ধবেরা তো বটেই সাধারণ মানুষেরাও মনে করে আশ্চর্য এক জীব।এখন হয়তো চিত্রটা অনেকখানি বদলেছে। কিন্তু সেই চার পাঁচের দশকে  এরকমই ছিল গ্রামগুলির অবস্থা। বখাটে ছেলেরাই যেন কবিতা লেখে।কবিতা লিখলে পড়াশোনা হয় না।মানুষ উচ্ছন্নে যায় । ফলে বন্ধু বান্ধবের টিটকিরি আর ব্যঙ্গবিদ্রূপ তো ছিলই।স্কুলের শিক্ষকেরাও হয়ে উঠেছিলেন বিভীষিকা । ক্লাসে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে কিছু কিছু স্যার বলতেন – দেখেছিস স্বয়ং রবি ঠাকুর চলে এসেছেন। সারা ক্লাস তখন হো হো করে হেসে পড়ত অট্টহাসিতে।এই ব্যঙ্গ বিদ্রূপ গুলির মোকাবিলা করা একজন কিশোরের পক্ষে খুব কষ্টের এবং বেদনার।যা তাকে মনে মনে আরও নিঃসঙ্গ আরও একাকী করে দেয়।গ্রামে যাত্রা হত তখন এখনও হয়। কিন্তু বাবাকে আমি যাত্রায় অভিনয় করতে কখনও দেখিনিফুটবল খেলার কথাও সেভাবে শুনিনি । খেলাধুলার উপর বাবার যে প্রবল আগ্রহ ছিল এরকম কোন নমুনা আমার নজরে পড়েনি । শুধু ঠাকুমার কাছে শুনেছিলাম ভলিবল খেলতে গিয়ে একবার হাত ভাঙানোর কথা।এটুকুই বাবার ক্রীড়া কর্মসুচি।এমনকী আমরা যখন ছোটবেলায় অল্পবিস্তর খেলাধুলা করতাম তখনও বাবার সেসব নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না।পরে আমি ভেবে দেখেছি কেন খেলাধুলা থেকে এই নির্বাসন? কেন এই বিচ্ছিন্নতা ? এর কারন সেই সময়ের বন্ধুবিহীন বন্ধুর পথে চলতে চলতে এক তীব্র একাকীত্ব গ্রাস করে নেয়। আর এই নির্জনতাই  নিজেকে সামগ্রিক আয়োজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল কবিতায় নিক্ষেপ করে।কবিতা এতটাই ধ্যান জ্ঞান হয়ে পড়ে যে পড়াশোনায় অমনোযোগ পরিলক্ষিত হয়বিচ্ছিন্ন একাকী এবং নিজের ভেতর গুটিয়ে  যাওয়া কিশোরটি মুক্তির দিশা খুঁজে পেয়েছিলেন কবিতায় এবং ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে । ঠিক এই জায়গাতে এসেই তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন নিজের সম আদর্শের এবং সম ভাবনার কিছু পরিজন।পড়ার বইগুলো ক্রমেই অসহ্য হতে শুরু করে তাঁর ।নীরস নিরর্থক অক্ষরের ভেতর কোন প্রাণের স্পন্দন নেই। তার উপর শিক্ষকদের ব্যঙ্গ , বিদ্রূপ আক্রমণ শানিত ছুরির মতো বুকের মাঝে বিঁধে থাকত দীর্ঘ দীর্ঘকাল। ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নেও অনেক শিক্ষক তখন সরকারি নীতির সমর্থক।  তাঁদের সমর্থন কখনও কখনও দালালির পর্যায়ে নেমে যেত  যা সহ্য করাও মুশকিল হয়ে উঠত বাবার পক্ষে । তখনই আরও আক্রমন বিনা কারণে বেত্রাঘাত, সামান্য কারণে অপদস্ত করা বা অপমান করার এক উল্লাসে ফেটে পড়তেন শিক্ষকেরা। এই পর্যায়ে দিনের পর দিন মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে বাবাকে। ফলে স্কুল ক্রমেই বিভীষিকার মতো হতে থাকে তাঁর কাছে ।
এর মধ্যে  জোরদার হয়ে ওঠে সত্যাগ্রহ আন্দোলন। সরকার আরও অমানবিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। বিভিন্ন জেলা থেকে মানভূমে চাল এবং অন্যান্য খাদ্য সরবরাহের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর প্রতিবাদে আরও উত্তাল হয় মানভূম।ঘরে ঘরে অরন্ধনের মধ্য দিয়ে পাল্টা প্রতিবাদ জানানো হয় সরকারের জনবিরোধী এই কালা নীতির বিরুদ্ধে। পাশের জেলা বাঁকুড়া থেকে ট্রাকে করে জোর করে খাবার নিয়ে আসার চেষ্টা করা হলেও সরকারী হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়। এইভাবে নীতির প্রশ্নে সমর্থনের প্রশ্নে সরকারকে যখন কোণঠাসা করে তুলেছে এই জেলার সর্বস্তরের মানুষ ।তখন সরকার পেটে মারবার সিদ্ধান্ত নেয়। কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রিতে বাধা দিতে শুরু করে। কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রয়কারীদের গ্রেপ্তার করে জনমানসে তাদের আগ্রাসী এবং হিংসাত্মক চেহারাকে সম্পুর্নভাবে নগ্ন করে দেয়। এই প্রেক্ষিতের ভেতর দিয়েই মানভূমের হালজোয়াল আন্দোলন দানা বাঁধে। প্রতিটি গ্রামে প্রকাশ্যে হাল এবং জোয়াল বিক্রির মধ্য দিয়ে সরকারী আইন অমান্য করে এই জেলার মানুষ তাদের শক্ত মেরুদণ্ডকে আরও ঋজু টানটান করে তোলে।এই ডাংরা নদী এবং তার চারদিকেও তখন এই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ এসে  হুমকি দিয়ে গেলেও জনতা বেপরোয়ামানুষের সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি দেখে সরকার ভীত আতঙ্কিত ফলে  এখানে পুলিশ দাঁত ফোঁটাতে না পারলেও জেলার বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারীদের  উপর অত্যাচার নেমে আসে।বাবুলাল মাহাত নামে পনের বছরের এক জন্মান্ধ কিশোরকে  তিন মাসের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাথে ১০০০ টাকা জরিমানা ।পিটিদারী গ্রামে আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয় বিহার পুলিশ। ঘরে ঢুকে মহিলাদের উপর অশালীন আচরণ অবধি করে।এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের এক দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য জেলাবাসীকে মর্মাহত করে –বিহার সরকার মানভূমে বাংলা ভাষার প্রচার এবং প্রসারে যেভাবে কাজ করে চলেছে তাকে অভিনন্দন জানাই পশ্চিমবঙ্গের  সরকার সর্বতোভাবে বিহার সরকারের এই উন্নয়নমুখী কাজকর্মকে সমর্থন করে            
  এই হল সেই সময় যখন অঙ্ক ইতিহাস আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান সব গোলমাল হয়ে যায় অঙ্কের খাতা জটিল সুত্রের বদলে ভরে উঠে কবিতার উপাদানে।  আমাদের  জেঠুমনি ত্রিবেনী প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন যেহেতু তিনি ছিলেন ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় তাই  সকলকে  পড়ানোর এবং সঠিক ভাবে গাইড করার দায়িত্ব ছিল তার উপরই । নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি বাবা কাকু এবং তিন পিসিমনির পড়াশোনাও দেখতেন ।  বাবাকে একদিন হাতেনাতে ধরলেন – এতক্ষন ধরে বকে যাচ্ছি , দেখি কি করেছিস? বাবার তখন  বিপাকে পড়া অবস্থা না পারছেন কবিতার খাতা লুকোতে না পারছেন অঙ্কের খাতা দেখাতে । আসলে অঙ্ক তো হয়ই নি ।  
খুব বকলেন । পড়া বাদ দিয়ে কবিতা । তারপর খাতাটা টেনে নিলেন – কই দেখি কেমন লিখিছিস।সারা খাতা জুড়ে কবিতার পর কবিতাসরকারের বিরুদ্ধে আগুন হয়ে ফুটে উঠেছে  আবেগ কোথাও কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম আভায় স্বপ্নের প্রস্তুতিকোন অঙ্ক নেই । অঙ্ক করা ব্যর্থ প্রয়াসও নেই । জ্যামিতিক চিত্র নেই । পাতার পর পাতা জুড়ে কবিতার অবয়ব শুধু।নিঃশব্দে খাতাটা নামিয়ে রাখলেন মাদুরের উপর।গম্ভীরভাবে তাকালেন বাবার দিকে – লিখবি , অবশ্যই কবিতা লিখবি । এত সুন্দর লিখিস তা তো আমি জানতাম না ।  তোকে আমি অনেকগুলো খাতা এনে দেব । তার মধ্যে লিখবি।পড়াশোনার খাতায় লিখিস না।কবিতা লিখতে গেলেও পড়াশোনা করতে হবে।কে কেমন লিখছে জানতে হবে। বাড়িতে একটা লাইব্রেরী করব আমরাসেখানে কিছু বই থাকবে । বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ।
সেই ভাবনা থেকেই দেশবন্ধু পাঠাগার নামে একটি লাইব্রেরীও করেছিলেন  জেঠুমনি  সেখানে ছোটদের বই এবং পত্রিকা রাখার ব্যবস্থা করেছিলেনপরে বড়দের বইও এতে জায়গা পায়।

-       এই লাইব্রেরী একদিন অনেক বড় হবে । প্রচুর বই আর পত্র পত্রিকায় ভরে উঠবেবইএর চেয়ে আন্তরিক বন্ধু আর কেউ নেই দুনিয়াতে ।  (ক্রমশ )  


No comments:

Post a Comment