কথোপকথন
অমিতাভ মৈত্র ও অনুপম মুখোপাধ্যায়
তৃতীয় পর্ব
অনুপম মুখোপাধ্যায়
প্রশাসক হিসেবে সমাজের কী চেহারা
দেখেছেন?
অমিতাভ মৈত্র
ছোটবেলায়, এমনকি
বড় হয়েও আমি চেয়েছি, রাতজাগা একটু লাল, ঘুমন্ত চোখ হতে, - যা বেলুনের মত সারারাত আকাশে ঘুরে
বেড়ায়। সাদা একটা অনুল্লেখযোগ্য বেলুনের মত। সেই বেলুন
হওয়া আর হল না অনুপম। ভেসে বেড়ানো হল না।
কিন্তু এই অবাধ্য পৃথিবীকে কখনও বিবমিষা
লিখে, কখনও ভালবাসায় দেখা হল
একটু!
২০০০ এর সেই বন্যা মনে পড়ে? সেই মহাপ্লাবন? ভেসে গেল সবকিছু। কৃষ্ণনগরে ডি এম অফিসে তখন একসিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়িয়ে একটু বড় দায়িত্বে আছি। থাকি কৃষ্ণনগর রবীন্দ্রভবনের পিছনের সরকারী আবাসনে। জল নেই, বিদ্যুৎ নেই। আমার দায়িত্ব ছিল ভাতজাংলায় ফুড কর্পোরেশনের গোডাউন থেকে সারা জেলায় খাদ্য সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখা। কৃষ্ণনগর করিমপুর রাস্তা বন্ধ। তবে বিশাল সম্ভাবনা খুলে গেছে জলপথের। কৃষ্ণনগর শহরের দু’তিনটে ঘাটে নৌকোর ভিড়।
কোথায় কত শো কুইন্ট্যাল চালগম পাঠাতে হবে তার নির্দেশিকা এওয়া হত। সেই মত ব্যবস্থা। এফ সি। এর সব কর্মচারী /কুলি, Weigh bridge এর operator/কয়েকশো ট্রাক ড্রাইভার, অ্যাসিস্টান্ট...আর সমানে বেজে যাওয়া তিন চারটে ফোন। সকাল ছ’টা থেকে রাত দশটা এটাই ছিল প্রতিদিনের দৃশ্য।
কতদূর গ্রামে গ্রামে, কত ত্রাণ ছাউনিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভাতের আশায় বসে। আর আমার সামনে রাস্তায় দু’পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে দু’তিনশো ট্রাক। ড্রাইভাররা ট্রাকের ধারেকাছে নেই। যাবে না তারা। (চাপ তো কম দিতে হয়নি ওদের গত কয়েক দিনে!) প্রত্যেক গাড়িতে লাঠির গুঁতো দিয়ে ড্রাইভারের খোঁজ করা হয়। চারপাশে বোতল খুলে বসে থাকা লোকগুলো এক কথায় জানাতে থাকে “নেই।”
তখন সিকিউরিটিকে দিয়ে লোহার রড এনে হেডলাইট ভাঙা শুরু করতে তারাই শুরু করল চালকত্ব স্বীকার করতে। মাল পাঠানো শুরু হল। কয়েকজন তখনও অনড়। কোমল লাঠির আঘাতে তৈরি করে দেওয়া গেল তাদেরও। স্বহস্তে।
এবং আমি প্রথম জানলাম আমার মধ্যে এমন এক অর্জন যা শুধু নিজের মধ্যে রাখার। এমন অর্জন সুখী করে না কিন্তু জোর এনে দেয়। বন্যার দিনগুলোয় (“কলেরার দিনগুলোয়”) কীভাবে সবাই বেঁচেছে, আমিই বা কীভাবে- এসব কিছুই আর একটা সময়ের পর “নারীর হাস্যের মত অবান্তর” (সুনীল) হয়ে যায়। রাত দু’টোয় তিনতলা অফিসের জানলা থেকে দেখেছি স্বচ্ছ আকাশ। দক্ষিণ দিক উদ্ভাসিত করে বৃশ্চিকরাশি দাঁড়িয়ে। আমার রাতের সরকারী ফ্ল্যাটে ফিরে সম্পূর্ণ অন্ধকার ঘরে আমি বিছানা থেকে উঠে জানলা আটকে যেন ঠেকাতে চাইছি রক্তের গমনধ্বনির মত নিঃশেষ জলের শব্দ সারা চরাচর জুড়ে। কান যেন ফেটে যেত একঘেয়ে, মৃদু, পরিত্রাণহীন সেই জলের শব্দে।
অনুপম
২০০০ এর সেই বন্যা মনে পড়ে? সেই মহাপ্লাবন? ভেসে গেল সবকিছু। কৃষ্ণনগরে ডি এম অফিসে তখন একসিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়িয়ে একটু বড় দায়িত্বে আছি। থাকি কৃষ্ণনগর রবীন্দ্রভবনের পিছনের সরকারী আবাসনে। জল নেই, বিদ্যুৎ নেই। আমার দায়িত্ব ছিল ভাতজাংলায় ফুড কর্পোরেশনের গোডাউন থেকে সারা জেলায় খাদ্য সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখা। কৃষ্ণনগর করিমপুর রাস্তা বন্ধ। তবে বিশাল সম্ভাবনা খুলে গেছে জলপথের। কৃষ্ণনগর শহরের দু’তিনটে ঘাটে নৌকোর ভিড়।
কোথায় কত শো কুইন্ট্যাল চালগম পাঠাতে হবে তার নির্দেশিকা এওয়া হত। সেই মত ব্যবস্থা। এফ সি। এর সব কর্মচারী /কুলি, Weigh bridge এর operator/কয়েকশো ট্রাক ড্রাইভার, অ্যাসিস্টান্ট...আর সমানে বেজে যাওয়া তিন চারটে ফোন। সকাল ছ’টা থেকে রাত দশটা এটাই ছিল প্রতিদিনের দৃশ্য।
কতদূর গ্রামে গ্রামে, কত ত্রাণ ছাউনিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভাতের আশায় বসে। আর আমার সামনে রাস্তায় দু’পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে দু’তিনশো ট্রাক। ড্রাইভাররা ট্রাকের ধারেকাছে নেই। যাবে না তারা। (চাপ তো কম দিতে হয়নি ওদের গত কয়েক দিনে!) প্রত্যেক গাড়িতে লাঠির গুঁতো দিয়ে ড্রাইভারের খোঁজ করা হয়। চারপাশে বোতল খুলে বসে থাকা লোকগুলো এক কথায় জানাতে থাকে “নেই।”
তখন সিকিউরিটিকে দিয়ে লোহার রড এনে হেডলাইট ভাঙা শুরু করতে তারাই শুরু করল চালকত্ব স্বীকার করতে। মাল পাঠানো শুরু হল। কয়েকজন তখনও অনড়। কোমল লাঠির আঘাতে তৈরি করে দেওয়া গেল তাদেরও। স্বহস্তে।
এবং আমি প্রথম জানলাম আমার মধ্যে এমন এক অর্জন যা শুধু নিজের মধ্যে রাখার। এমন অর্জন সুখী করে না কিন্তু জোর এনে দেয়। বন্যার দিনগুলোয় (“কলেরার দিনগুলোয়”) কীভাবে সবাই বেঁচেছে, আমিই বা কীভাবে- এসব কিছুই আর একটা সময়ের পর “নারীর হাস্যের মত অবান্তর” (সুনীল) হয়ে যায়। রাত দু’টোয় তিনতলা অফিসের জানলা থেকে দেখেছি স্বচ্ছ আকাশ। দক্ষিণ দিক উদ্ভাসিত করে বৃশ্চিকরাশি দাঁড়িয়ে। আমার রাতের সরকারী ফ্ল্যাটে ফিরে সম্পূর্ণ অন্ধকার ঘরে আমি বিছানা থেকে উঠে জানলা আটকে যেন ঠেকাতে চাইছি রক্তের গমনধ্বনির মত নিঃশেষ জলের শব্দ সারা চরাচর জুড়ে। কান যেন ফেটে যেত একঘেয়ে, মৃদু, পরিত্রাণহীন সেই জলের শব্দে।
অনুপম
নিজেকে সাধারণ
বাঙালি জীবনে, ছাপোষা বাঙালিদের
মধ্যে আজ কতটা বেমানান লাগে? চায়ের দোকানের উত্তেজিত মানুষদের
সাথে আইডেন্টিফাই করতে পারেন? নাকি, বিশেষ দেওয়াল ছুঁয়ে রোল
প্লে করেন?
অমিতাভ
চায়ের দোকান, কোন স্যোশাল গ্যাদারিং সব জায়গাতেই তোমার ঝকঝকে মুখটাই আশা করে সবাই। একধরণের মানসিক ক্যাটওয়াক যাকে বলে। র্যাম্পে বেড়ালের পায়ে হেঁটে যায় যে, তার জীবন তো সে দেখতে দেয় না। আমি চায়ের দোকানে রোজ একটু করে সময় কাটাই। রাজনীতি, পি এন পি সি- এসবে গা গুলোয়চায়ের দোকানে প্রায় ৫০ জনের সাথে খুব চমৎকার বন্ধুত্ব- ৫ বছর ধরে। মাত্র ৪ জনের নাম এখনো পর্যন্ত জানি। বাকিরা জানেন না যে আমি তাদের নাম টুকুও জানি না। এভাবেই চমৎকার সম্পর্কগুলো টিকে আছে।
অনুপম
আপনাকে পোস্ট-মডার্ন কবি বলা হল। সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হলেন। অবিশ্যি আমি সঠিক জানি না ১৯৯০-এর দশক পেরিয়ে পোস্ট-মডার্ন কবি কী জিনিস। আপনি কি 'বিদ্ধ করো, তির'-এও যথেষ্ট পোস্ট-মডার্ন ছিলেন না? যাই হোক, যার এমন জীবন, তাকে কি পঞ্চাশ অতিক্রান্ত বয়সে পোষ্ট-মডার্ন আখ্যাটা দিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন ছিল? এই জীবনের যিনি অধিকারী, তাঁকে পেলে দাস্তাইয়েভস্কি বা ডিকেন্স তো লুফে নিতেন!বালক অমিতাভ মৈত্র ডিকেন্সের আগ্রহের বিষয় হতে পারতেন, চাকরিজীবী অমিতাভ মৈত্র হতেন দাস্তাইয়েভস্কির কোন উপন্যাসের জটিল নায়ক,
হয়ত “দ্য ডাবল” এর চেয়েও
অনেক গভীরতাময়, অনেক সুদূরপ্রসারী। আমার ইচ্ছে
আছে আপনাকে নিয়ে একটা আখ্যানমূলক কাজ করার। প্রস্তুতি
নিতে হবে। এই কথোপকথনও একটা প্রস্তুতি।
অমিতাভ
আমিও জানি না এরকম দাঁতভাঙা নামের
থিওরিগুলো খায় না মাখে? লোন দেবার পর ডি আর ডি সি/ব্যাঙ্ক গরুর কানে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়- যাকে বলে তকমা!
গরু কিন্তু ঘাস খেয়েই যায় তবু। লোনের গরু
এই ট্যাগে স্বস্তি ও নিরাপদ বোধ করে হয়ত।
যারা ভাগ্যবান লোনের গরু তাদের কথাই বলছি- ইয়ে, আমি কি তোমার মুখে
কোনো মুহূর্তের ফিচেল হাসি দেখতে পেলাম? অনুপম?
না, আমাকে পোস্টমর্ডান কেন বলা হয়, আমি জানি না। আমি আমার পৃথিবীটাই লিখি-যেখানে পোষ্ট মর্ডানের কোন নাক গলানোর দরকার নেই।আমি একটা অদ্ভুত শাস্তির জগতে নিক্ষিপ্ত, যেখানে স্বাভাবিক সবকিছুই টলে যায়, অবিশ্বাসে টটস্থ হয়ে থাকে। আমি একটা মানে খুঁজতে চেয়েছিলাম। ভেসে বেড়াতে চাইনি! খুব চিৎকারের সঙ্গে অভিযোগ করিনি। যে চাকরিটা করেছি, আমার আগে ও পরে হাজার হাজার জন সেই কাজ করেছেন, হয়তো আরো বেশি দক্ষতার সঙ্গে। জীবনের বিষ-স্পর্শ তাঁরা ঝেড়ে ফেলতে পেরেছেন। হয়তো জন্ম থেকেই আমি সংক্রামিত ছিলাম- এই বিষের স্রোত থেকে আমার আর বেরোনো হল না। এক বিচারকক্ষ থেকে আরেক বিচারকক্ষে কী এক অবিশ্বাস্য আর অবাস্তব বেঁচে থাকার একটা উপায় খুঁজতে খুঁজতে, এক পরিত্রাণ খুঁজতে খুঁজতে আমি হারিয়ে গেলাম। টোটেম ভোজ এর ম্যাডাম এম সর্বতোভাবেই হয়ত আমি! বিচার হচ্ছে ম্যাডাম এম এর নামে। কিন্ত বিচার হচ্ছে আমারই।
যেন রক্ত দেওয়া হচ্ছে আরোগ্যের জন্য, এভাবেই চারদিক থেকে ভয়ঙ্কর এক জীবন যেন সজোরে অসহনীয়ভাবে আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল কেউ। এত রক্ত এত মৃত্যু এত বিষের মধ্যে নিজেকে নিয়ে ফেলে –সেন্ট ফ্রান্সিস অব অ্যাসিসির মত আমিও একই অপরাধ করেছি- “I have sinned against my own body …”
কৃষ্ণনগরে যে সরকারী আবাসনে থাকতাম, তার চারতলায় পঞ্চাশ পেরোনো এক পুরুষ ও মহিলা থাকতেন। অনেক দূরে কাজ করতে যেতেন পুরুষটি। অনেক রাতে ফিরতেন। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসারের সব কাজ করতে হত মহিলাকে। সিঁড়ির ওপর সারাদিনে অনেকবার ওঁর পায়ের শব্দ শুনতাম। ক্লান্ত পা, বিশ্রামহীন পা। কোন কোন ফ্ল্যাটের দরজা খোলা, হাসির শব্দ। উনি না থেমে উঠে যাচ্ছেন উপরে। উনিও তো ম্যাডাম এম এর বাইরে নন, অনুপম!
সিঁড়ির ওপর কখনো সাধারণ সৌজন্যের কথা হত তাঁর সাথে। কিন্তু এই লেখাটিতে কথাগুলো যেন সিনিস্টার হয়ে উঠল, প্রিমনিশন হয়ে উঠল কোনকিছুর- এসবের সাথে পোষ্ট মর্ডানের তত্ত্বকে কোনভাবেই কি জোড়া যায়, অনুপম? আমি জানি না।
অনুপম
না, আমাকে পোস্টমর্ডান কেন বলা হয়, আমি জানি না। আমি আমার পৃথিবীটাই লিখি-যেখানে পোষ্ট মর্ডানের কোন নাক গলানোর দরকার নেই।আমি একটা অদ্ভুত শাস্তির জগতে নিক্ষিপ্ত, যেখানে স্বাভাবিক সবকিছুই টলে যায়, অবিশ্বাসে টটস্থ হয়ে থাকে। আমি একটা মানে খুঁজতে চেয়েছিলাম। ভেসে বেড়াতে চাইনি! খুব চিৎকারের সঙ্গে অভিযোগ করিনি। যে চাকরিটা করেছি, আমার আগে ও পরে হাজার হাজার জন সেই কাজ করেছেন, হয়তো আরো বেশি দক্ষতার সঙ্গে। জীবনের বিষ-স্পর্শ তাঁরা ঝেড়ে ফেলতে পেরেছেন। হয়তো জন্ম থেকেই আমি সংক্রামিত ছিলাম- এই বিষের স্রোত থেকে আমার আর বেরোনো হল না। এক বিচারকক্ষ থেকে আরেক বিচারকক্ষে কী এক অবিশ্বাস্য আর অবাস্তব বেঁচে থাকার একটা উপায় খুঁজতে খুঁজতে, এক পরিত্রাণ খুঁজতে খুঁজতে আমি হারিয়ে গেলাম। টোটেম ভোজ এর ম্যাডাম এম সর্বতোভাবেই হয়ত আমি! বিচার হচ্ছে ম্যাডাম এম এর নামে। কিন্ত বিচার হচ্ছে আমারই।
যেন রক্ত দেওয়া হচ্ছে আরোগ্যের জন্য, এভাবেই চারদিক থেকে ভয়ঙ্কর এক জীবন যেন সজোরে অসহনীয়ভাবে আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল কেউ। এত রক্ত এত মৃত্যু এত বিষের মধ্যে নিজেকে নিয়ে ফেলে –সেন্ট ফ্রান্সিস অব অ্যাসিসির মত আমিও একই অপরাধ করেছি- “I have sinned against my own body …”
কৃষ্ণনগরে যে সরকারী আবাসনে থাকতাম, তার চারতলায় পঞ্চাশ পেরোনো এক পুরুষ ও মহিলা থাকতেন। অনেক দূরে কাজ করতে যেতেন পুরুষটি। অনেক রাতে ফিরতেন। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসারের সব কাজ করতে হত মহিলাকে। সিঁড়ির ওপর সারাদিনে অনেকবার ওঁর পায়ের শব্দ শুনতাম। ক্লান্ত পা, বিশ্রামহীন পা। কোন কোন ফ্ল্যাটের দরজা খোলা, হাসির শব্দ। উনি না থেমে উঠে যাচ্ছেন উপরে। উনিও তো ম্যাডাম এম এর বাইরে নন, অনুপম!
সিঁড়ির ওপর কখনো সাধারণ সৌজন্যের কথা হত তাঁর সাথে। কিন্তু এই লেখাটিতে কথাগুলো যেন সিনিস্টার হয়ে উঠল, প্রিমনিশন হয়ে উঠল কোনকিছুর- এসবের সাথে পোষ্ট মর্ডানের তত্ত্বকে কোনভাবেই কি জোড়া যায়, অনুপম? আমি জানি না।
অনুপম
“পতনকথা”
যখন লিখছেন, আর “টোটেমভোজ”
যখন লিখছেন, নিজেকে লেখক হিসেবে কোথায় আলাদা বোধ
করেছিলেন?
অমিতাভ
দশ বছর কবিতা থেকে দূরে থাকার পরে বইপত্রে মন দিচ্ছিলাম। তখনও 'টোটেমভোজ' শুরু হয়নি, শুধু অস্পষ্ট একটা আদল তৈরি হয়েছে ভেতরে। প্রভাত-দা (চৌধুরী ) চাইছিলেন আমায় লেখায় ফেরাতে। কেননা কোথাও আর লিখছিলাম আ তখন। এজন্যই উনি বইয়ের পাণ্ডুলিপি চাইছিলেন,যদিও জানতেন আমার কাছে লেখা নেই। অগত্যা এক সপ্তাহের মধ্যে ছত্রিশটা চতুষ্পদী লিখে নাসেরকে দিয়েছিলাম। সেটাই ‘পতনকথা’ নামে পাতলা বই হয়ে বের হয়। ‘পতন কথা’ থেকে ‘টোটেমভোজ সম্পূর্ণ আলাদা। দু’টো বইয়ের ব্যবধান মাত্র দুই বছরের। ‘পতনকথা’ আর ‘টোটেমভোজ থেকে দু’টো কবিতা এখানে দিলে আর বিস্তারে কথা বলার দরকারই হবে না!
ওপরের কবিতাগুলো ‘পতন কথা’ থেকে । কবিতা পাঠকের জন্য কোনো rude shock এখানে নেই। যা ‘টোটেমভোজ’ এ আছে। ‘টোটেম’ এর ভাষা প্লাষ্টার করা হাতের মত শক্ত, আড়ষ্ট, কৃত্রিম। দাঁন্তের নরক ও পরিশুদ্ধিতে আমি মুক্তি খুঁজছিলাম তখন। সাথে বাইবেল এবং কাফকা। “Inferno” –তে নরকের দরজায় লেখা ছিল –“Leave every hope, ye, who enter.” আমি সেটি ব্যবহার করেছিলাম বইয়ের শুরুতেই। পাঠকের জন্য সেটা ছিল একটা সতর্কবাণী; বিন্দুমাত্র কবিতা পড়ার আশা এই বই থেকে করবেন না যেন। জীবনকে বোঝার জন্য ম্যাডাম এম-এর মরিয়া চেষ্টা। তার দু একটা অংশ দেওয়া যাক!
ডায়েরিতেই লেখা থাকে। জীবনে তার প্রয়োগ হয় না কিন্তু। তিনি দেখেন, বিশ্লেষণ করেন, বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু জীবনে নেমে আসেন না। খুব ভেতরে তিনি আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু, এগিয়ে আসা সাহায্য তিনি ফিরিয়ে দেন, নিষ্প্রয়োজন মনে করে।
“ম্যাডাম এম”ভাবেন তার ডান পাঁজড়ে খ্রীষ্টের মতেকটা ক্ষত ও রক্তপাত থাকা দরকার। খ্রীষ্টের যন্ত্রণার অংশ তিনি পেতে চান। বৃষ্টির রেনকোট হাঁটু অবধি ভেজা অনুভূতির মধ্যে হয়ত কোথাও অবরুদ্ধ যৌনতা আছে। তলস্তয়ের “ফাদার সিয়ের্গি” গল্পে একজন তৃষ্ণার্ত নারীর আহ্বান প্রতিহত করতে ফাদার সিয়ের্গি কুড়ুল দিয়ে নিজের হাতের আঙুল ছিন্ন করে রক্তাক্ত হাত লুকিয়ে দিব্যতাময় প্রসন্নমুখে সেই নারীর সামনে দাঁড়াতেন। তিনি জরা। তিনি হারিয়ে দিয়েছেন তার শরীরকে। এই কবিতাটির মধ্যে কোথাও হয়ত ফাদার সিয়ের্গি আছেন। অনুপম, আমি বিশ্বাস করি, রক্তক্ষরণ ছাড়া মানুষ জয় পেতে পারে না। ছেলেবেলায় অন্ধকারে শ্রীধরের সাথে মাথা ফাটিয়ে রক্ত ঝরানোর খেলার মধ্যেও একটা মুক্তির আনন্দ থাকত। দু’বছর আগে অসতর্ক অবস্থায় লোহার আলমারির ধারালো প্রান্তে মাথা অনেকটা কেটে রক্তে যখন চুল কপাল গেঞ্জি ভিজে যাচ্ছিল আমার- আমি এক জয় ও মুক্তির আনন্দ পেয়েছিলাম তার মধ্যে। মনে মনে চাইছিলাম আরো রক্ত বেরিয়ে যাক শরীর থেকে। হয়ত এভাবেই সুন্দর হয়ে উঠব আমি- ঠিক যেভাবে ম্যাডাম এম প্রশ্ন করেছিলেন- “সুন্দর দেখাবে আমাদের?” এই কবিতাটা পড়েই এবারের কিস্তিটা শেষ করা যাক।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment