।। বাক্‌ ১১৯ । পুনরাধুনিক কবিতামূলক কাজ । অনুপম মুখোপাধ্যায় ।।





ফিল্ম নয়ার

।। এই লেখার বডি আছে। ডেডবডি নেই। শট বিভাজন আবছা হলে যতটা সংবেদন হয়এখানে লুকিয়ে আছে হিংস্র কম বেতনভূক লস এঞ্জেলেস ৩ তলায় পুরোদমে স্ট্র্যাটেজিক ভয়েস ওভার ২ তলা চানঘর গোয়েন্দা হিস্‌স্‌ হিস্‌স্‌ জীবন মিলে যায়। যেমতি। স্বচ্ছ গ্লাভস্‌ পরা হাতে নরম নেলক্লিপ্‌ধার পরীক্ষার দরকারই নেই। কাজ পরিচয়। ক্লিক্‌। ক্লিক্‌। ক্লিক্‌ ক্লিক্‌ ক্লিক্‌পাকা নখে রক্ত নেই কাঁচা নখে চুল জড়িয়ে আছে। তন্বী ও পটীয়সী দেবীটির চুল তাঁর কোন অঙ্গের চুল। ভেবো না। বাথটব ভর্তি ছিল। স্নান ত শুদ্ধ ছিল না। হ্যান্ডশাওয়ার আশ্চর্য পুংলিঙ্গ বিশেষ। দিবস ১ হার্ডবয়েলড্‌ বিরস উৎসব। একা হলে সেখানে ঘরময় ২০শ শতাব্দীর যত আত্মা উঠে আসেনউদভ্রান্ত আত্মারা ক্ষয়ে যাওয়া সাবান ভালোবাসেননিঃসঙ্গতার ধরণ হয় আলোছায়ায় টাক্সিডুর রকমফের হয়। ভেতো আঙুলের ছাপ নিতে রুখে উঠল কড়া নীল এলিটিস্ট টাইপরাইটার। একক অক্ষরকে নিরাশ মাঝারি বলে না১ দিকে জন্তু অন্যদিকে দেবতা। পিছু ধাওয়া করতে হবে আধখানা লোকেরতুমি কি লেখক তুমি সিক্রেট এজেন্ট। মন্দিরে চেয়ে ছিলে প্রণতা রমণীর ভাঙা-ভাঙা নিতম্বের দিকেওজেন্সির চাপ থেকে ধান্দা বাদ দাও অহেতুক শ্যাডো করো পুরো মাপ জিজ্ঞেস কোরো না।





রবীন্দ্রনাথের প্রতি

।। বাঁশি নাকি ৪৫ ডিগ্রি কোণে রাখার কথা। আমার কনুই অনুসারে। কবি হওয়ার শামিয়ানা তো টাঙিয়ে দ্যায়নি কেউ। কবিতা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা হদ্দ হয়ে গেছে। এখন খুব ভিতরে দিলে লেখক হিসেবে শেষ হয়ে যাব। আবার বের করে ছাড়তে গিয়ে নিজের গায়ে পড়ে যাচ্ছি গাড়ি পিছলে যায় ভাঙা ছাতা ঠেকনা দিয়ে আটকে রাখতে হয়। বোলপুরে শিলং পাহাড়ে এই নিয়ম চালু হলঝর্নাতলায় ও কার টুথপেস্টপাহাড়গুলো জোব্বা। ওহে কাঠঠোকরার শাস্তিআমি আমার চোখ হাতে তোমার ভিতরে যাব। আমার অধিকার আছে লেখার ডিমে সবরকমের তা দেওয়ার। এই ছোট্ট বাগানে গাছের ছায়াগুলোকে ত বড় দ্যাখায়বায়োকেমিক বাক্স হাতে এগোচ্ছেন উনি। কার কনুই খারাপ গো। কার বাঁশি। মৈত্রেয়ী দেবীর ফুল ছাড়া উনি কবি। কিংবা ম্যানড্রেক। প্রশান্তকুমার পালের অত খণ্ডের ফল ছাড়া উনি কবি। অথবা প্ল্যানচেটের খলখলে হাসিযাই হোন রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক হোন হতে না পারা জলের মতো নন। অত শিশু উনি হচ্ছেন কোথায়। বাংলাদেশের সমতলকে ওষুধ করে। খাঁ খাঁ মাঠে প্রেম কত উঁচু হতে পারেবিগড়ে যাওয়া দাঁতের মতো কবিজীবনসত্যি আটকে যাওয়ার সর্বোচ্চ সীমাটাই মুক্তি।


গদ্য লেখকের কষ্ট

।। রোদ তো সহে নেব। তাতা বালি কী করে সইব। ওগো লেখা তোমার চাকর রাখো মোরে। আমার দুঃখের কথা তোমার মুখে অপমান শোনায়ছেঁড়া ভাষা নিষিদ্ধ হয়েছে। দোক্তার বীজ পড়ে তামাকের বন হয়ে যায়হাল্কা নেশা কোনো পারভার্সন নয়। চিন্তা চাইঅনুস্বার আর সেমিকোলনের পার্থক্যের মতো নয়। চিন্তা। ঠিকভাবে কব্জি ধরলে থ্রম্বোপ্লাসটিন ছাড়া ছেঁড়া রক্ত শুকনো হয়ে যায়। কিন্তু। স্বচ্ছ গেলাসে জলকে পাৎলা মনে হয়। সমুদ্রগর্জন ঢেলে জবাকুসুমসঙ্কাশ ডেটল নেবে কে। তেমন চওড়া নাট্যশালা কই। ঘুম ছাড়া এখানে অঘোর ও নিঃশব্দ কিছু কইজানলায় ফুলকি তুলে আঁদ্রে ব্রতঁ-র কবিতা মনে পড়েজোর হাওয়া জেমস জয়েসের গদ্য চওড়া হয়মেঘ ডাকলে বন্যা হবে লেখাটার ১ তলাও ডুববে। গদ্য লেখকের কষ্ট নিয়ে বসে আছে ১ হাঁটু লেখাদরজায় কমলালেবু ঝুলিয়ে পাঠকের নজর কাটে না ঘোর টক পাতিলেবু কড়া লঙ্কা চাইচিন্তা করো। মোহ নয় নিসর্গ নয় মেয়েদের পেচ্ছাপ নিয়ে নদীর ঘুমে আসে জ্যোৎস্নামাখা নদ ঠাপ্‌ করে শব্দ হয় খাটেউহার নাম আদিম বিশ্বাস। তেনার নাম হিমবতী দাসীই নিদ্রা সুখদণ্ডের চেয়ে ভারি ও পিচ্ছিল নিঃশব্দ দণ্ড ঘিরে ডাইনিরা হাসেচোষে কিন্তু জিভ নেই। মৃদু দাঁত দ্যায়। ওয়েল্ডিং ছাড়া জুড়ে দেওয়া আকাশ আর বালি এই ঘরে জল থেকে উঠে যায় সহজ লেখায়সমুদ্রআর্নেস্ট হেমিংওয়ের ঘোমটারো ঘোমটা ফেলে দ্যায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভার্চ্যুয়াল গোড়ালি ভাঙতেবাতাসে হাত ঘোরাই লেখা তোমার ঘোর কাটাই। হাত। কোথায় ট্রেনে কেনা রুম ফ্রেশনার। পৃথিবীতে ১ ফোঁটা জল পেলে ১টা চিন্তামাছ আরেকটাকে তাড়া করে খেতে চাইবেবাজে পোড়া তালগাছ জ্যোৎস্নার গলবিলে মধ্যমা উঁচু হয়ে আছেকালো বালির সৈকতে আধোধোয়া লাল সাইকেল। হবো। চলো হবো। মনেরই তো বেধ। তল। বাঁচারই তো কোণ। মদ। জল। মুড়ি। মিছরি খাই মিশরীয় ভেবে। ধোনে প্রাণে পুরোহিত নিয়ে কী করে বাঁচবো। চামড়া সরিয়ে নিয়ে আঙুল বোলাইকিবোর্ড তাকিয়ে আছেমুঠোয় মাউস আরকালচে হাতের এই গঙ্গাজল হল।।





প্রতিভামূলক

।। প্রতিভার কপাল হল দেরিতে শুরু করা। অনন্ত বাজার সামনে। ওইজিনিয়াসের মধ্যে কোনো হুড়োহুড়ি নেই। গভীর রাতে পাড়ার মোড়ে নির্জন দাঁড়িয়ে থাকে সারাদিন ভাড়াখাটা গাড়ি। উদাসীন জাঁদরেলগোটা গায়ে ফোঁটা ফোঁটা ধুলো ধুলো বৃষ্টির ঘাম। ১দিন এই ছোট শহর থেকে ও ঠিক ঘুরে আসবে। লুম্পেনপুর ছেড়ে মাফিয়াবাজার ফুঁড়েউত্যক্ত চাঁদ তখন ছিঁড়তে চাইছে মেঘের বোর্ডগেমল্যাম্পপোস্টটা আকাশ কেটে রাস্তায় চাপ নিচ্ছে এখুনি হেরে যাবে হয়ত। বৃষ্টি আসছে আবার। কিংবা বৃষ্টি আজ আর আসবে না সারারাত। সব জল গড়িয়ে যাবে ভেতরে ভেতরেহাল্কা চপ্পলের আওয়াজ। যে হাঁটছে তার পা থেকে আসছে বাড়ি ফিরছে সে অথবা চপ্পলের শব্দ তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেএই। প্রতিভার কপাল হল খুব ধীরে একঘরে রক্তাক্ত হওয়া।।   

  

সবুজ বারান্দা

।। বড় হয়ে লোকে আর পিঁপড়ে পোষে না। ধূর্ত বয়টা যেমন ১টা চুমুক মেরে কালো কফি ঠক্‌ করে নামিয়ে দিয়ে গেছে আমি জানি দেখেছি। তবুখেয়ে নিচ্ছিফাঁকা ক্যাফের জানলা দিয়ে দেখছি রাস্তাভর্তি হলদে হাওয়া দাঁড়িয়ে আছে একা সবুজ বারান্দার দিকেজানালার কাচে আমার রাস্তামাখা মুখটার ছায়া আমার ভিনদেশি শুকনো আয়ুউড়োখুড়ো মফসসলি চুল। ট্র্যাফিকের নাকি শুরু হয় না শেষ হয় না। কলকাতায় মানায় না আমাকে। চুপিচুপি শহরে কলকাতায় যাই। কষ্ট পেলে ইচ্ছে হয় ঢুকে পড়ি চাইল্ড স্পেশালিস্টের আশ্চর্য গাড়িতে। নিজের গ্রাম্য গু নিজে টেস্ট করিগ্রাম্য থুতু নিয়ে প্যাথোলজিকাল কিছু সিদ্ধান্তে আসি। মুখ ভরে বলে উঠি অনুপম মুখো। মনে হয় হাঁয়ের মধ্যে পৃথিবীর যত বাতাস জন্ম সার্টিফিকেট নিয়ে লোফালুফি করছে। রোগের কিছুটা সারাতে গিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হতে ভালো লাগে না একটু আগে রণপায়ে চড়ে দুজন রঙিন লোক কীসব হ্যান্ডবিল ক্যাফের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে গেলসেগুলোরই টা দেখিয়ে বয়টা মালকিনকে হাসিয়ে দিচ্ছে। এখন। সামনে কফির সাদা খালি মগঠিক। আমার সামনে আমার খালি মগ।।

 

ছুটির ঘাম

।। ঘাম উড়ে যেতে যেতে তোমার উপরে কিছু শোধ নিতে পারে লোমকূপে লাথি মেরে নুন-নুন শিশি খুলে দেবেসে শিশিতে ছিপি নেই লীনতাপ আছেশরীরে বেঁটে আর খসখসে হিম ঘনাবেসিলিং ফ্যান ঠিকঠাক হলে ঘাম হয়ে যায় স্বচ্ছ সিরাপ যে কোনো জায়গা থেকে চেটে নেওয়া যায়। এসির সে ক্ষমতা নেই। দেহ আর শরীরের বর্ডারলাইনে অনুভূতির ফাটলগুলো রসে ভরে গেলে এসির কোনোকিছু করার থাকে না। যদি। পূর্ব-ভারতীয় গ্রীষ্মকালকে খাঁটি বাঙালি হয়ে ভোগ করতে চাও। বাড়িতে নকল কোনো শীত রেখো না। তার চেয়ে দিঘা থেকে কিনে আনা প্রবাল আর কড়ি মাখা হাতপাখা নাওপরিপূর্ণ ছুটির দিনে ধপধপে সাদা টেবিল ফ্যান তোমাকে ট্র্যাভেলগের মতো পথ দেখাবে। খাট হল বেড়ানোর শ্রেষ্ঠ জায়গা। কে তোমার উপরে থাকবে। ফর্সা অথচ ঘেমোকে তোমার নীচে। রোগা অথচ মাংসলপেছন থেকে নেবে। নাকি উপরে বসে। ঘাড়ের দিকে লক্ষ্য রেখো সাক্‌ করতে গিয়েও। হাওয়া চলাচল নিয়ে নিরীক্ষা চলে না। চাপ দিতে দিতে নিতে নিতে বাঁ হাতে খুলে দিও বাগানের দিকে সব জানলার কাচ। পাঁচিল আছেশান্ত। ধীর। দশাসইফার্ন ও গরমে শ্যাওলা ভাপেবাগানভর্তি ট্র্যাফিকের আওয়াজ। কাচগুলো চোখে রাখা সাদা ভারি ভেজানো রুমাল। সুখ কত আসে যত চোখে দেখতে নেই। নিজস্ব কিচেনের আবহাওয়া ও রং বিকালের পিকনিকে নিয়ে যেও নামাংস পোড়াতে গিয়ে হাতের কাছে যেন থাকে বুক আর পেট মোছার নরম টাওয়েল। সবাইকে দেখিয়ে মুছবে। পরিশ্রমের স্মৃতিগুলো মশার মতো ঘিরে এলে নরম থাপ্পড়ে নিকেশ করে দাও। ঘামের ফোঁটায় যে চোরাবালি থাকে যে কোনো ছুটিকে স্ফূর্তিবান ঘোড়ার মতো ডুবিয়ে মেরে ফ্যালেবিকালে কি ভাববে নাকি আজ কেন ঘুম ভেঙে সকালের আমেজ আসেনি। ভেবো না। ওয়্যার খোলা বালিশের মতো শ্রমহীন অবশিষ্ট। ছুটিটা কাটাও।। 



কুমারসম্ভব

।। টবের ফুলের নাম ফিক্‌। কীভাবে যে খোলে তার শরীরের ফাঁস। ১বার শুরু হলে তার আর হাঁচি থামে না। গাছ কি জঙ্গলের ভুলভাল রেণু চুষছিল। ব্যালকনির মেয়ে তো ৩য় নয়ন খুলে ভালোবাসা করে। রফিক্‌-কে। রফিক্‌ কী করবে। তোমরা তো কুত্তা নিয়ে শোও। কুত্তা। ইংরেজি কুত্তা। ইংরেজ নয় ইংরেজ নয়। ডগ। ডগি। স্প্যানিশ সারমেয়। কেউ কারো জাত তুলতে পারে না। যত আমাকে ভালোবাসো আমি কেন জাত তুলব তোমার। কেউ জাত তুলতে পারে না ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফ্যালে। রেললাইন কাটা থাকে পুরানো প্রেমিক। বাপের ছাত ফুটো হলে হর্নি মেয়ে পাতা খাবে। পেয়ে যাবে হরিণীকুটির। প্রেমিকের কপালে আগুনগলাভরা বিষভালোবাসা চেনে না যে তাকে কেন বিরহী বিবাগী বানাও। যা খুশি মাংস খাও। চোখ কেন খাও। খুব বেশি প্রেম হলে শরীরে রক্ত কমে যায়চেন ঢিলে হয়ে যায় পরিচিত প্রেমের খাঁ খাঁ দুপুরটবে হেলান দ্যায় কার্তিকের মা।।




                                                       (চিত্রঋণ : Joan Miro, Sidney Paget)


1 comment:

  1. 'কষ্ট পেলে ইচ্ছে হয় ঢুকে পড়ি চাইল্ড স্পেশালিস্টের আশ্চর্য গাড়িতে। ' এত সরলভাবে নিজেকে পেলাম এই লেখাগুলোতে.... কিংবা
    'আমি আমার চোখ হাতে তোমার ভিতরে যাব। আমার অধিকার আছে লেখার ডিমে সবরকমের তা দেওয়ার। এই। ছোট্ট বাগানে গাছের ছায়াগুলোকে কত বড় দ্যাখায়। '- মন ছুঁয়েযাচ্ছে...প্রতিভামূলক এবং সবুজ বারান্দা মন কাড়লো আমার!

    ReplyDelete