।। দ্য ব্যান্ড’স ভিজিট
।।
ইসরায়েলের ‘আরব কালচারাল সেন্টার’এ অনুষ্ঠানের জন্য ইজিপ্ট
থেকে আটজনের একটি পুলিশ অর্কেস্ট্রা দল এসেছে। যার পোশাকি নাম
'দ্য আলেক্সজান্দ্রিয়া সেরিমনিয়াল
পুলিশ অর্কেস্ট্রা'। কথা ছিল বাস থেকে নামার পর ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করবে। কিন্তু বাস থেকে নেমে বুঝল তাদের অভ্যর্থনার কোনো আয়োজনই নেই! বেশ কিছুক্ষিন ফাঁকা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা ছোটো বাস দেখে কমান্ডার এগিয়ে গিয়েও বুঝল, না ওদের জন্য নয়। ছোটো বাসটি পারিবারিক ট্যুরের জন্য বেরিয়েছে। দলের কমান্ডার
তৌফিক পাবলিক বুথ থেকে কয়েকবার কালচারাল সেন্টারে ফোন করেও ব্যর্থ হলো। অন্য প্রান্তের
বাঁজখাই গলার রিসেপসনিস্ট হয় তৌফিকের কথা ঠিক ঠাক বুঝতে পারলেন না
বা পাত্তা দিলেন না। দ্বিতীয়বার
তৌফিকের নাম শুনেই ভদ্রমহিলা লাইন কেটে দিলেন। এর একটা কারণ হতে পারে, তৌফিক নামের মানুষটি এতটাই সজ্জন ও নিজের পদমর্যাদাকে সম্মান দেন,
ফোন ধরে বিষয়ের আগে নিজের পুরো ঠিকুজি কুষ্টি জানানো জরুরী মনে করেন। যেমন, ‘আমি দ্য আলেজান্দ্রিয়া সেরিমনিয়াল
পুলিশ অর্কেষ্ট্রার চিপ কমান্ডার তৌফিক জাচারয়্যা বলছি'....। কার এতো সময় আছে এ সব
উপাধি টুপাধি শোনার?
ফ্যাসাদে পড়ল অর্কেস্ট্রা দলটি। বাস টার্মিনাসে খোঁজ নেওয়ার পর আরও একটি বাস ধরে কিছুটা এগিয়ে গেল। সেখান থেকে আরও একটা বাস ধরে যেতে হবে নির্দিষ্ট স্থানে। কিন্তু যখন নামল বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। ফাঁকা উদোম মাঠে জিজ্ঞেস করবে তেমন কাউকে চোখে পড়ল না। দূরে, লাইন ধরে ফ্ল্যাট। মাঠের মধ্য দিয়ে সেদিকেই রওনা দিল ব্যান্ড পার্টি। যদি কেউ কিছু সন্ধান দিতে পারে! একটি রেস্টুরেন্ট দেখে এগিয়ে গেল তোফিকরা। দুজন যুবক রেস্ট্রুরেন্টের বাইরে বসে আড্ডা মারছিল। তৌফিককে দেখে যুবকদুটি কোনো দায়িত্ব না নিয়ে রেস্ট্রুরেন্টের মালকিনকে ডাকল, 'ডেনা একজন কমান্ডার ভদ্রলোক কী জানতে চাইছে এসে দ্যাখো।' খটাখট চটির শব্দ কানে এল তৌফিকের। কিছুক্ষনের মধ্যে সামনে এসে দাঁড়াল এক মহিলা। যুবতী বলা যাবে না। ৩৫/৪০ বছর বয়সের হলেও এককথায় খুবই অ্যাট্রাকটিভ। নিম্নাঙ্গে জিন্সের প্যান্ট কয়েক পাট গোটানো। উর্ধাঙ্গে একটি পাতলা টি সার্ট। মহিলার ক্যাজুয়াল পোশাক ও দাঁড়ানোর ভঙ্গি আরও যেন অ্যাট্রাকটিভ করে তুলেছে। কথা বলার সময় ঘাড়, বুক, পাছা দোলানো বা চুল ঝাঁকানো, সর্বোপরি চোখের প্রতিটি কোষের মুভমেন্ট যে কোনো পুরুষকে কাত করে দিতে পারে! তৌফিক নারী সম্বন্ধে খুবই যে শ্রদ্ধাশীল তার চোখমুখের ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়। ডেনার এই অ্যাট্রাকশন খুব একটা ছায়া ফেলল না তার চোখে। বয়স ৫০-এর আশেপাশে। এককথায় আন-ইমপ্রেসিভ মুখ। নাকটা বেশ লম্বা। নাকের ডোগা ভোঁতকা। গালে বিশেষ মাংস নেই, কিন্তু বসন্তের দাগ রয়েছে। কথাও বলেন নিচু গলায় নাটকীয় ঢঙে। বুক পকেট থেকে চশমা আর একটি চিঠি বের করল। চশমা পরে পড়তে লাগল চিঠিটি। ডেনা বলল, ‘এখানে কোনো আরব কালাচারাল সেন্টার নেই’।
তৌফিক একপ্রকার নিরাশ হয়ে ফিরল, এবং দলবল নিয়ে নিজেরাই জায়গা খুঁজতে পথে পা
বাড়াল। কিছুটা এগোনোর পর থমকে দাঁড়াল সর্বকনিষ্ঠ খালেদ।
চিপ কমান্ডার তোফিককে উদ্দেশ্য করে বলল, 'আমরা কি না খেয়েই সারাদিন কাটাবো? কাল তবে আমাদের ডেডবডি অনুষ্ঠান করতে উঠবে? 'তৌফিক খুব ভালো করেই বুঝেছে কার গলা! কে বলেছে কথাগুলো। তবুও ঘুরে দাঁড়িয়ে, 'কে বলল কথাগুলো?'
প্রায় একই কথা আবার বলল খালেদ। তবুও তৌফিক কিছুটা তড়পানির ঢঙে এগিয়ে এসে, ' কে, কে বলল কথাগুলো?' এমন ভাবে এগিয়ে এল, যেন যে বলেছে তাকে দেখে নেবে। কিন্তু আরও কয়েকজনের একই অভিযোগ।
'সারাদিন না
খেয়ে কতক্ষণ আমরা চলতে পারি?'
তৌফিক দলবল নিয়ে আবার ফিরে এল ডেনার রেস্ট্রুরেন্টে।
'ম্যাডাম, আমরা তো খুবই বিপদে পড়েছি। যদি আমাদের একটু সাহায্য করেন’।
ডেনা বলল, ‘কী সাহায্য’?
‘মানে আমাদের একটু যদি
ডিনারের ব্যবস্থা’
ডেনা বলল, ‘এটা্ তো খাওয়ারই
জায়গা, রেস্ট্রুরেন্ট’!
‘না মানে আমাদের কাছে খুব
বেশি ইসরায়েলি টাকা নেই, যদি সামান্য পাঁউরুটি আর একটু কিছু ব্যবস্থা করেন তাতেই
হয়ে যাবে। ইজিপ্টশিয়ান টাকা কি চলতে পারে?’
ডেনা সবার জন্য খাবার ব্যবস্থা করল, কিন্তু তৌফিক কিছুই খেল না।
তৌফিকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে
ডেনা জানালো, সেদিনের মতো লাস্ট বাস চলে গিয়েছে। তৌফিক জানতে চাইল, আশেপাশে কোনো
হোটেল আছে কিনা। স্বভাবতই অতো ছোটো টাউনে কোন হোটেল নেই। ডেনা সেটাই জানাল।
তৌফিক বলল, ‘আপনি এমনিতেই এত
করলেন আমাদের জন্য, আর কত আমরা আপনার কাছে চাইবো?’
ডেনার বুঝতে অসুবিধা হলনা,
এসব ফর্মালিটিজের কথা তৌফিক ভদ্রতাবশত বলছে। বাস্তবিকই ওদের কিছু করার নেই এই
মুহূর্তে। ডেনা কথা না বাড়িয়ে
পাড়ার যে
দুজন ওর
দোকানে আড্ডা মারে তাদের একজনকে বলল,
'তোদের বাড়িতে তিন চারজনের ব্যবস্থা কর, বাকিটা আমি দেখছি’। ছেলেটি মৃদু আপত্তি করেছিল, কিন্তু
ডেনার ব্যক্তিত্বের ওপরে গিয়ে কিছু বলতে পারল না। পেপি বলে আর একটি ছেলে, তারও বাড়িতে তিনজনকে পাঠাল। নিজের ছোটো ঘরে ব্যবস্থা
করল তৌফিক আর খালেদের।
এবারের ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বিভাগে 'দ্য ব্যান্ড'স ভিজিট'। ২০০৭ এ বানিয়েছে এরান কোলিরিন। এরানকে এ
প্রজন্মেরই পরিচালক বলা যেতে পারে। কিন্তু কী অসামান্য সহজ প্রকাশে গতিময় পৃথিবীর গতিময়তা কায়দাবাজির বিপরীতে
হেঁটে আটপৌরে অথচ গভীর ভাবনার চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গিয়েছেন! 'দ্য ব্যান্ড'স ভিজিট' বেশ কয়েকবছর আগে দেখি 'ওয়ার্লড্ মুভিজ'
চ্যানেলে। তবে কোনো বারই পুরোটা দ্যাখা হয়নি। পরে সংগ্রহ করে পুরোটা দেখেছি। এরানের 'ব্যান্ড'স ভিজিট'
দেখলেই বোঝা যায় গ্রীসের পরিচালক অ্যাঞ্জেলোপোলোসকে ও হৃদয়ে জায়গা দিয়েছে। আত্মস্থ করেছে, অনুকরণ করেনি।
অনুকরণ করেনি বলেই জীবনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রে বিশ্ব সিনেমা জগতে 'ব্যান্ড'স ভিজিট'
সম্মানের একটা জায়গা করে নিয়েছে।
ছবির ঘটনায় আর একবার আসে যাক। ইসরায়েলের ছোট্ট এক শহরে তৌফিকের নেতৃত্বে পুলিশ ব্যান্ডের দলটির এসে পড়া। অপরিচিত জায়গার অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে অনিচ্ছাকৃতভাবে একটা রাত কাটানো। আর তার মধ্য দিয়েই উঠে এল সমাজ, মানুষ। প্রতিটি মানুষের অন্তরে লুকিয়ে থাকা প্রেম ভালোবাসা কামনা, বঞ্চনা কষ্ট কত কি! পলক ফেলা যায় না প্রতিটি মুহূর্তে। মূলত তৌফিকের চোখ দিয়েই বেশিরভাগটা দ্যাখানো হয়েছে। তাছাড়াও ওদের টিমের সেকেন্ড ইন কমান্ডারের চোখ দিয়ে কিছুটা। যে দলে ক্ল্যারিওনেট বাজায়। ঘটনাক্রমে জানা যায় সন্তান প্রসব করতে গিয়ে স্ত্রী বিয়োগের পর নিজের সৃষ্ট সুর (কনসার্ট) শুরু করেও আর শেষ করতে পারেনি। ডেনার ব্যবস্থা করা প্রতিবেশীর বাড়িতে এসে দোলনায় দোলা ফুটফুটো সদ্যোজাতকে দেখে নিজের সন্তানকে মনে পড়ায় চোখ চিক চিক করে ওঠে। আঙুল দিয়ে সদ্যোজাতর কচি আঙুল নাড়তে নাড়তে কখন আপন মনে সুর ভাঁজা শুরু করে দ্যায়। এতদিনের অসমাপ্ত কনসার্ট পূর্ণতা পেতে থাকে। অপূর্ব এই অধ্যায়। এরানের মতো বয়সীর এমন গভীর ভাবনা বিস্ময় জাগায়!
তৌফিকের চরিত্র কেমন আগেই বলেছি। ডেনা যেন ঠিক ওর বিপরীত। তবুও তৌফিককে ওর বেশ পছন্দ। হয়তো নারী হিসেবে তৌফিক যে সম্মানটা তাকে দিচ্ছে, যা এতকাল কেউ তাকে দেয়নি। সবাই ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখেছে। কিন্তু তৌফিক সবার থেকে যেন আলাদা। সন্ধের পর তৌফিককে নিয়ে ডেনা ঘুরতে বেরোয় শহরে। বেরোনোর মুখে টেলিফোন বুথের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলেকে দ্যাখায় ডেনা। যে ছেলেটি সন্ধে থেকে গভীর রাত, কখনো সারারাত টেলিফোনের বুথের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, কখন তার বান্ধবীর ফোন আসবে!
দলের অন্যান্যরা
খাওয়া দাওয়া করলেও তৌফিক কিছু খায়নি। নিজে দলের চিফ কমান্ডার হয়েও এতজনকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হলো, তার জন্য
কোথাও একটা খারাপ লাগা রয়েছে ওর মনে। আমন্ত্রিতদের
প্লেনে নিয়ে যাওয়া যেত। বিশেষ করে এক দেশ থেকে আর এক দেশে অনুষ্ঠান করতে গেলে। কিন্তু তেমন ব্যবস্থা করেনি কর্তিপক্ষ। বাসেই আসতে হয়েছে। তার জন্যই বিদেশ বিভুঁইয়ে এই বিপত্তি। খারাপ লাগা অপমান সব ওকে গ্রাস করেছে। ডেনার মুখে প্রায় বিশ্রাম নেই। তবুও যেন তৌফিক সহজ হতে পারে না। শহরের একটা রেস্টুরেন্টে ডেনা তাকে কিছু খাওয়ার অনুরোধ করলেও তৌফিক খেল না। খুব জোরাজুরি করতে এককাপ লাল কফি নিয়ে ডেনার সঙ্গে বসল। কিছুক্ষন পর রেস্টুরেন্টে এলো দুই সন্তান সহ একটি পরিবার।
ডেনা কর্তাটির দিকে আঙুল নেড়ে দেহ ও মাথা ঝাঁকিয়ে তৌফিককে বোঝালো ওই লোকটির সঙ্গে তার একদা কী সম্পর্ক ছিল! হয়তো কোনো মানে নেই, তবুও লোকটির সঙ্গে তৌফিককে হ্যান্ডশেক করিয়ে,
তৌফিক যে
একজন মিউজিক্যাল ট্রুপের
চিফ কমান্ডার সেই পরিচয় দিয়ে একটা ক্ষীণ প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করল। আলাপ শেষে লোকটিকে দেখিয়ে নিচু গলায় তৌফিককে বলল, 'সন অফ এ বিচ',
দা রিয়্যাল সন অফ এ বিচ।'
ওদিকে খালেদের একা একা ভালো লাগছিল না। ডেনার আস্তানায় আসার পর ডেনা খালেদকে প্রায় পাত্তাই দেয়নি। খালেদকে দুগ্ধপোষ্য শিশু মনে হয়েছে হয়তো তার! তবে সুযোগ বুঝে সে কিন্তু ডেনার পুরো শরীরে ভালো করেই চোখ বুলিয়ে নিয়েছে। ডেনা হয়তো খালেদের প্রায় ডবল বয়সের, তবুও তার অ্যাট্রাকশন খালেদকে কাত করেছে।
খালেদ রাস্তায়
বেরিয়ে দেখলো রেষ্ট্রুরেন্টে যে দুটো ছেলে আড্ডা মারে তার একজন দাঁড়িয়ে আছে কোথাও যাওয়ার জন্য। ছেলেটির মুখ প্রায় প্যাঁচার মতো সবসময় বেঁকে থাকে। একবারও তাকে হাসতে দেখেনি সে। নাম পেপি। পেপের মতো বাঁকা! জানা গেল তার বন্ধু আর
বান্ধবীর সঙ্গে সে পার্টিতে যাবে। খালেদ বলল, ‘একা একা আমার ভালো লাগছে না
চল তোমাদের সঙ্গে রাতে ঘুরে আসি।’ পেপি চাইছিল না, কিন্তু খালেদ অনুনয় বিনয় করে ওর বন্ধুর গাড়িতে চেপে বসল। কিছু বাদে দুটি মেয়ে ওদের গাড়িতে এসে উঠল। তাদের একজন যে গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছিল তার বান্ধবী। সঙ্গে যাকে এনেছে তাকে ঐ পেপির সঙ্গে ভিড়িয়ে দিতে। পেপি মেয়েটিকে দেখেই বলল, ‘এ তো ’গ্লুমি গার্ল! সত্যিই মেয়েটির
মুখ বিষণ্ণতায় ভরা। গাড়িতেও মুখ হাঁড়ি করে বসে থাকল। ওদের অস্বস্তি দেখে খালেদ বলল,
‘আমাকে নিয়ে কিছু ভেবোনা। তোমরা তোমাদের মত থাকো। আমি শুধু শহরটাকে দেখবো। পার্টিতে এসে 'গ্লুমি
গার্ল' কিন্তু
বেশ খোস মেজাজে। মুখে একচিলতে হাসিও দ্যাখা যাচ্ছে। কিন্তু পেপির মুখ আরও প্যাঁচা হতে থাকল। তার তো একবিন্দুও পছন্দ হয়নি এমন দুখিমুখী মেয়েকে! মেয়েটি নাচতে নাচতে পেপিকে নিবিড় করে কাছে চাইছিল। হাত ধরতেই জোরে মেয়েটিকে একপ্রকার ঠেলে ফেলে দিল পেপি। মেয়েটির চোখে নেমে এল অশ্রু। একপাশে
মুখ নিচু করে বসে চোখের জল ফেলতে লাগল। পেপি বন্ধু ও বন্ধুর বান্ধবিকে
চিৎকার করে বলতে চাইল, ও কাঁদছে, কিন্তু
তারা
পাত্তা দিল না। খালেদ সব দেখছিল একটু দূরে বসে। ছেলেটি ইশারায় খালেদের দিকে তাকিয়ে বলতে চাইল, তবে আমি এখন কী
করবো? হালেদ ইশারায় বলল,
ওর কাছে এগিয়ে যাও। ছেলেটি এগিয়ে গেল। এর
পর ধাপে ধাপে খালেদ যা
ইশারা করল ছেলেটি তাই করতে থাকল। বোঝা যায়,
ছেলেটি একেবারেই অকর্মন্য এবং ব্যক্তিত্বহীন। আর খালেদ চোস্ত খেলোয়াড়। খালেদের ইঙ্গিত মতো একসময় ছেলেটি
'গ্লুমি গার্ল'কে জড়িয়ে চুমুও খেল।
ডেনারা রেস্টুরেন্ট থেকে
বেরিয়ে পার্কে বসল কিছুক্ষণ। আসলে
ডেনার জীবনে হয়তো এমন দিন এই প্রথম। তাকে সে ভাবে কেউ সম্মান দেয়নি এমন করে।
পুরুষের কাছে নিজেকে হয়তো এর আগে নিরাপদও মনে হয়নি। ডেনা চাইছিল তৌফিকের সঙ্গে অনেক
অনেক সময় কাটাতে।
তৌফিক কিন্তু সবসময় প্রায় গুটিয়েই। তার ভেতরে যেন কি এক কষ্ট লুকিয়ে! জানা গেল
তৌফিকের স্ত্রী ছেলে দুজনেই আত্মহত্যা করেছে। আর তার কারণ তৌফিক নিজে। সে নিজেকে
কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছে না!
তৌফিক আর ডেনা ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে খালেদও। ডেনা ফ্রিজ থেকে হুইস্কি বের করে টেবিলে রাখল। সঙ্গে তিনটি গ্লাস। তৌফিককে আমন্ত্রন জানাল, রাতটা আজ আনন্দ করেই কাটানোর জন্য। তৌফিক বলল, ‘ম্যাডাম কাল আমাদের প্রোগ্রাম আছে। সারাদিনও যথেষ্ট দৌড় ঝাঁপ হয়েছে। আমি ক্লান্ত, আর পারছিনা। আমাকে এবার একটু ঘুমোতেই হবে।’ ডেনা আরও দু একবার অনুরোধ করলেও তৌফিক রাখতে পারল না। খালেদ কিন্তু নড়তে চায় না। দাঁড়িয়ে রইল। যদিও ডেনার তাকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সে চেয়েছিল তৌফিকের সঙ্গেই কিছুটা রাত কাটাতে। তৌফিক যাওয়ার আগে খালেদের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘বেটা, কাল প্রোগ্রাম আছে, আমি চাই তুমিও রাত না জেগে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়’।
মাঝরাতে তৌফিকের ঘুম ভেঙে
গেলো। পাশে খালেদের দ্যাখা নেই। প্যান্ট গলিয়ে আস্তে আস্তে বৈঠক খানায় এসে এদিক ওদিক তাকানোর পর পাশের ছোটো ঘরে আদ
ভেজানো দরজা দিয়ে দেখল ডেনা আর খালেদ যৌনমিলনে
মত্ত! প্রথমে বিস্মিত হলেও আস্তে আস্তে তার মুখরেখায় এক টুকরো মুচকি হাসি দ্যাখা গেল!
এবার বিদায় নেওয়ার পালা।
গতরাতেরর ঘটনা স্বচক্ষে দেখলেও ডেনার প্রতি কোনো রাখাপ লাগা অনুভূতি তৌফিকের চোখে
ধরা পড়ল না। ডেনা দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। তার মনটা ভালো নেই বোঝা যাচ্ছে। বডি
ল্যাঙ্গুয়েজে সেই প্রগলভতা নেই। শান্ত মেয়েটি যেন বিদায় জানাতে এসেছে। ভেতরের কষ্ট
কাউকে বুঝতেও দিতে চায়না। তৌফিকের দিকে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে
নিল। তৌফিক অজস্রবার ধন্যবাদ জানালেও ডেনা প্রায় কোনো কথা বলল না। একটা ছোট্ট কাগজ
তৌফিকের হাতে দিল। ওদের যেখানে
প্রোগ্রাম করতে যাওয়া কথা তার ঠিকানা। আগের দিন তৌফিক সঠিক উচ্চারণে জায়গাটার নাম
বলতে পারছিল না। ফলে ওরা বিপদে পড়তে পারত।
তৌফিক দলের সবাইকে ডেনার
প্রতি হাত নেড়ে অভিবাদন জানাতে বল। সবাই হাত নাড়লেও খালেদের হাতনাড়ার উৎসাহ যে
সবার থেকে একটু বেশি, তা তৌফিকের চোখ এড়ালো না। যদিও ডেনা খালেদের দিকে তেমন তাকালোই
না। বিষণ্নভরা মুখে সেও হাত নাড়ল মাত্র।
পরের দৃশ্যে তৌফিকদের কনসার্ট
করতে দেখা যায়।
ঘটনাবলী থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না ছবির নির্মাতা কী ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন। প্রায় প্রতিটি ছবির আলোচনায় ঘটনা
বর্ণনার ওপর আমি একটু জোর দিই। তার
কারণ আগেও বলেছি। বোদ্ধাদের জন্য তাত্বিক আলোচনা একেবারেই আমি করতে চাইনি। যাঁরা এ ধরণের ছবির সন্ধান পাননা
বা একটু উদাসীন, কাহিনি জেনে যদি
তাদের এ ধরনের ছবি দেখার আগ্রহ তৈরি হয়। এবং আমি জোরের সঙ্গে বলতেই পারি,
অনেকেই
আলোচনা পড়ার পর ছবিগুলো দেখেছেন এবং এমন ছবির খোঁজ করছেন।
'ব্যান্ড'স ভিজিড' যে কারণেই বার বার দ্যাখা যায়, তা হলো তৌফিকের চরিত্রে 'সলে বাকরি' আর ডেনার চরিত্রে 'রনিত এলকাবেতে'র অনবদ্য অভিনয়। প্রতি মুহূর্তের চোখ মুখের অভিব্যক্তি, শরীরী মুভিমেন্টের এমন উপস্থাপনা আমি খুব কম দেখেছি। দুর্ভাগ্য ডেনা চরিত্রের এই অসামান্য ইসরায়েলি অভিনেত্রী গতবছর (২০১৬) দুরারোগ্য ক্যান্সারে মাত্র ৫১ বছর বয়সে চিরতরে বিদায় নেন। অনেক অনেক অসামান্য অভিনয়ে যে সমৃদ্ধ করে যেতে পারতেন বিশ্ব চলচ্চিত্রকে সে ব্যাপারে আমি জোর গলায় বলতে পারি।
পরিচালক এরাণ কলিরিন যে গ্রীসের পরিচালক অ্যাঞ্জেলো পোলোসকে হৃদয় দিয়ে আত্মস্ব করেছেন তা ওঁর ছবির ফ্রেম দেখলে বোঝা যায়। অন্তত আমার অ্যাঞ্জেলোপৌলোজের কথা মনে এসেছে। বিশেষ করে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ধরা দেখে।
Eran Kolirin (Hebrew: ערן קולירין) (born 4 November 1973) |
এ ছবির
যে দিকটা আমার খারাপ লেগেছে, তা হল অকারণে
অতিরিক্ত ইংরেজি ডায়ালগ বাবহার করা। ইজিপ্ট
থেকে পুলিশ ব্যান্ড পার্টি ইসরায়েলে এসে কথাবার্তায় এতো ইংরেজির ব্যবহার না করলে কি চলছিল না? প্রায় প্রতিটি চরিত্রই ইংরেজিতে কথা বলেছে। সে কারণেই একাডেমি পুরস্কারের তালিকা থেকে 'দ্য ব্যান্ড'স ভিজিট' বাদও পড়েছে। অস্কার কমিটির
নিয়ম ৫০% এর বেশি বিদেশি ভাষা ব্যবহার
করলে সে ছবিকে বাতিল বলে গন্য করা হবে। বড় কথা সেটা নয়। অতিরিক্ত ইংরেজি ডায়ালগ খুবই অবাস্তব মনে হয়েছে। মূলত যে জায়গার ঘটনা, তা একটা ছোট্ট টাউন। যেখানে হোটেল পর্যন্ত নেই। অর্থাৎ যে টাউনে বিদেশিদের আনাগোনা প্রায় নেই।
বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার
মানুষজন। সেখানকার সাধারণ মানুষ এমন সাবলীল ইংরেজি ভাষা বলে কি করে? এ ব্যাপারে আর একটু
চিন্তা ভাবনা করলে সর্বাঙ্গসুন্দর হতো
'দ্য ব্যান্ড'স ভিজিট'।
ছবির নাম শুনলে যেটা মনে হয়, হয়তো মিউজিকের প্রাধান্য থাকবে। বাস্তবে কিন্তু পরিচালক খুবই সংযমের পরিচয় দিয়েছে। একদম শেষ অংশে কনসার্ট বাজানো ছাড়া সারা ছবিতে তেমন মিউজিক প্রায় নেই। তবে যে বিখ্যাত আমেরিকান মিউজিসিয়ান 'চেট বেকার'-এর (Chet Baker) নাম ঘুরে ফিরে এসেছে, ছবির মিউজিকেও তার প্রভাব রয়েছে। চেট বেকারের মিউজিকের সঙ্গে অ্যারাবিয়ান মিউজিক মিশে এক অনবদ্য সুরের মুর্ছনা ঝরে পড়েছে ছবির শেষাংশে।
ছবির নাম শুনলে যেটা মনে হয়, হয়তো মিউজিকের প্রাধান্য থাকবে। বাস্তবে কিন্তু পরিচালক খুবই সংযমের পরিচয় দিয়েছে। একদম শেষ অংশে কনসার্ট বাজানো ছাড়া সারা ছবিতে তেমন মিউজিক প্রায় নেই। তবে যে বিখ্যাত আমেরিকান মিউজিসিয়ান 'চেট বেকার'-এর (Chet Baker) নাম ঘুরে ফিরে এসেছে, ছবির মিউজিকেও তার প্রভাব রয়েছে। চেট বেকারের মিউজিকের সঙ্গে অ্যারাবিয়ান মিউজিক মিশে এক অনবদ্য সুরের মুর্ছনা ঝরে পড়েছে ছবির শেষাংশে।
'দ্য ব্যান্ড'স ভিজিট' সংগ্রহ করা খুব একটা
কঠিন নয়। দেখুন। ভালো লাগতে বাধ্য। তৌফিক
আর ডেনার অভিনয় না দ্যাখা মানে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া!
No comments:
Post a Comment